‘তোমরা এসে আমাকে নিয়ে যাও। ট্যাংক খুব কাছে চলে এসেছে।’ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আগে আতঙ্ক জড়ানো কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে এ কথাগুলোই বলেছিল ছয় বছরের হিন্দ রজব। সেই হিন্দকে অবশেষে দুই সপ্তাহ পর গতকাল শনিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং তার স্বজনরা অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল তাকে হত্যা করেছে।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হিন্দের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা বলেছে, ‘হিন্দ তেল আল-হাওয়ার পেট্রল স্টেশনের বাইরে গাড়িতে থাকা বাকি সকলের সঙ্গে (ইসরায়েলি) দখলদার বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে।’
দাদা হামাদা বলেছেন, আজ ভোরে ইসরায়েলি বাহিনী সেখান থেকে সরে যাওয়ায় তাঁরা ওই এলাকায় পৌঁছতে সক্ষম হন।
গত ২৯ জানুয়ারির দুপুরের দিকের ঘটনা। এলাকা ছাড়তে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হুমকি আর অনবরত গোলাগুলির মুখে হিন্দকে নিয়ে গাজার বাড়ি থেকে পালাচ্ছিল তার চাচার পরিবার। গাড়িতে ছিল হিন্দ, চাচা-চাচি ও তাঁদের পাঁচ সন্তান। বাইরে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছিল সেদিন।
তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে পালাতে হিন্দকে চাচার গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন মা উইসাম।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে হিন্দের চাচার গাড়িটি ইসরায়েলি ট্যাংকের সামনে পড়ে গিয়েছিল। একে একে গাড়িতে থাকা হিন্দের সকল আত্মীয় মারা যায়। একমাত্র বেঁচে ছিল ছয় বছরের হিন্দ রজব। গাড়িতে আটকা পড়েছিল সে আর চারপাশে ছিল মৃত আত্মীয়রা।
এ সময় প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্টের সদর দপ্তরে হিন্দের চাচার নম্বর থেকে একটি কল গিয়েছিল। কল সেন্টার থেকে পাল্টা ফোন করা হলে ফোন ধরেছিল ছোট্ট হিন্দ।
এরপর বিপর্যস্ত মেয়েটিকে সাহস দিতে কয়েক ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যান কল সেন্টার কর্মী রানা। তিনি হিন্দকে গাড়ির সিটের নিচে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন। হিন্দ রানাকে বলেছিল, ‘তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাবে? আমি খুব ভয় পাচ্ছি।’
এর মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে ওই স্থানে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল রেড ক্রিসেন্ট। প্রায় তিন ঘণ্টা পর রেড ক্রিসেন্টের একটি অ্যাম্বুল্যান্স হিন্দকে উদ্ধারে রওনা হয়। এক পর্যায়ে ইউসুফ ও আহমেদ নামের দুই রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ফোনে রানাকে জানিয়েছিলেন, তাঁরা ঘটনাস্থলের একেবারে কাছেই। ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য তাঁদের তল্লাশি করতে আসছে। এটাই ছিল রেড ক্রিসেন্টের ওই দুই কর্মীর শেষ কথা। এরপর তাঁদেরও কোনো হদিসই মেলেনি। খোঁজ মেলেনি হিন্দেরও।
হিন্দের দাদা বাহা হামাদা এএফপিকে বলেন, ‘হিন্দ এবং গাড়িতে থাকা বাকি সবাই শহীদ হয়েছেন।’ তিনি বলেন, গাজা শহরের তেল আল-হাওয়া এলাকায় একটি পেট্রল স্টেশনের কাছে গাড়িটির খুঁজছিলেন তাঁরা। এবার এই ভয়ংকর দুঃসংবাদ পেলেন।
ঘটনার সময় রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা মাকে খুঁজে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এর আগে হিন্দের দাদা বাহা হামাদা বলেছিলেন, ‘মায়ের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল। তখন মেয়েটি বলেছিল, সে দূরে অ্যাম্বুল্যান্সটা দেখতে পাচ্ছে। এ সময় হিন্দের গাড়ির দরজা খোলার শব্দও পান তার মা। তার পরই কেবল নীরবতা।’ মায়ের কাছে ফেরা হয়নি হিন্দের।
হিন্দের মা জানান, হিন্দ বারবার বলেছিল, ফোনটা রেখে দিয়ো না। সে কোথায় ব্যথা পেয়েছে জানতে চেয়েছিলেন মা। কোরআন পড়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন এবং একসঙ্গে প্রার্থনা করছিলেন। মায়ের সঙ্গে প্রতিটি শব্দ পুনরাবৃত্তি করেছিল হিন্দ। বিবিসিকে মা উইসাম বলেছেন, ‘প্রতিটা মুহূর্ত বুকটা যেন জ্বলে-পুড়ে যায়। অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ শুনলেই মনে হয় ওরা হিন্দকে নিয়ে আসছে। প্রতিটা গুলির আওয়াজ, প্রতিটা ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার শোঁ শোঁ শব্দ শুনলে মনে হয় আমার মেয়েটার গায়ে লাগবে না তো!’
ঘটনার থেকে প্রতিদিন আহলি হাসপাতালের সামনে বসে থাকতেন উইসাম। মেয়ে ফিরে আসবে, সেই আশায়। মেয়ের সব জিনিসপত্র নিয়ে মা অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু হিন্দ আর কোনো দিন মায়ের কাছে ফিরবে না। ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর বিবিসি, সিএনএন ও এএফপির তরফ থেকে ওই দিনের ঘটনা জানিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে হিন্দ ও দুই রেড ক্রিসেন্ট কর্মীর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। এ ছাড়া সিএনএনকে ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছিল, তারা এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা জানেই না।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন