প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার, যার পথ চলায় সবই ছিল সমমাত্রিক

প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার। যার পথ চলায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা,
 সহ- শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম, ন্যায় বিচারিক কার্যক্রম, দানশীলতা, ধার্মীকতা সবই ছিল সমমাত্রিক। 

মহান আল্লাহু তাহালা পবিত্র কুরআনে ঘোষনা করেছেন “কুল্লু নাফসিন যা ইকাতুন মাউত” অর্থাৎ সকল প্রাণিই মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হবে। জন্মিলে মরিতে হবে এটাই চিরসত্য। মৃত্যু মানব জীবনে এক শাশ্বত অধ্যায়। মহান আল্লাহর এ বিধান কখনও ব্যতিক্রম হবে না। তবে কিছু মানুষের শারীরিক মৃত্যু হয় বটে, থেকে যায় কর্মময় জীবন। এ মহৎ কার্যাবলীর জন্যই তাঁরা অমরত্ব লাভ করেন, বেঁচে থাকেন মানুষের স্মৃতিতে। স্মৃতি-চির জাগরুক, স্মৃতি চির অম্লান যা কিছু আনন্দের-কিছু বিষাদের। মানুষ স্মৃতি চারণকারী....আমি যার স্মৃতিচারণ করছি সে এক মহান ব্যক্তিত্ব আমার প্রিয়ভাজন প্রয়াতঃ আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেব।

প্রয়াতঃ আব্দুন নূর মাষ্টার শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকই হচ্ছেন মানুষ গড়ার প্রকৃত কারিগর। একজন শিক্ষকই গড়তে পারেন আদর্শ মানুষ, একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা। শিক্ষককে বলা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অত্র এলাকার তথা মৌলভীবাজারের শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রয়াতঃ আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেব তাহাঁর মহান পেশার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জীবনে ফুটিয়ে দিয়েছেন জ্বলন্ত মশাল, করেছেন সাহসী, দিয়েছেন অনেক বড় হওয়ার প্রেরণা। পথ-প্রদর্শক হিসেবে তাঁহার এ আদর্শ ও স্মৃতি থেকে নতুন প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহণ করবে, দেখবে কল্যানের পথ।

তাঁহার চিন্তা চেতনায় ফুটে উঠেছে বঞ্চিত শোষিত মানুষের কথা। তাঁহার নির্দেশনা ও প্রেরণা শিক্ষার্থী ও যুব সমাজের মাঝে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। তাইতো মুসলিম-হিন্দু, ধনী-দরিদ্র, কৃষক-শ্রমিক সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সমস্বরণীয় হয়ে আছেন প্রয়াতঃ আব্দুন নূর মাষ্টার। তাঁর পথ চলায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক,সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম, ন্যায় বিচারিক কার্যক্রম, দানশীলতা, ধার্মীকতা এসবই ছিল সমমাত্রিক। 

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ত্রান সামগ্রী সংগ্রহ করা,খাদ্য ও ঔষধ নৌকায় করে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বিতরণ করা, এলাকার রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও মেরামত, বিদ্যুতায়ন, মামলা ,মকদ্দমা-শালিশ বিচারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে বিভিন্ন হয়রানীমূলক কাজ হতে এলাকাবাসীকে রক্ষা করাই ছিল তাঁর জীবনের রুটিন কাজ। এলাকাবাসীর সামগ্রিক উন্নয়ন করাই ছিল তাঁহার ব্রত। আমি ২০০৯ সালে পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে যোগদান করি। তিনি ছিলেন অত্র প্রতিষ্ঠানের আজীবন দাতা সদস্য। ২০১১ সাল থেকে অত্র প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে সংগত কারণে শ্রেণি কক্ষের সংকট দেখা দেয়। আমি (প্রতিষ্ঠান প্রধান) ২টি শ্রেণিকক্ষ নির্মানের জন্য পরিচালনা কমিটির সভায় প্রস্তাব উথ্যাপন করি। তখন পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্য মন্ডলীর সহযোগীতায় জনাব মরহুম আব্দুন নুর মাষ্টার সাহেব ঐ সভায় বসেই এলাকার ধনাঢ্য /শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সাথে মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে দুই লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন। এভাবে তিনি ২০১২ সালে ২-কক্ষ বিশিষ্ট, ২০১৫ সালে ৩-কক্ষ বিশিষ্ট, ২০১৮ সালে ৩-কক্ষ বিশিষ্ট মোট তিনটি সেমি-পাকা টিনসেট গৃহ নির্মাণে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম, সরকারি দিবস সমূহ উদযাপনে তাঁহার সরব উপস্থিতি সত্যিই অনস্বীকার্য। তিনি স্বাধীকার আন্দোলনের পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত চমৎকার ভাবে শিক্ষার্থীর মাঝে উপস্থাপন করেন। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা, সদালিপি সাহসী সাদামনের মানুষ ছিলেন। 

প্রয়াতঃ জনাব আব্দুন নূর মাষ্টার সাহেব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তবে রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। এলাকায় বয়ে যাচ্ছে শোকের বন্যা। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলার স্বপ্নে, কালের পরিক্রমায় তথ্য প্রযুক্তির যুগে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে মাইল ফলক হিসেবে পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয়কে কলেজে উন্নীতকরনে প্রয়াতঃ আব্দুন নুর মাষ্টার সাহেবের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আব্দুন নূর-নূর জাহান চৌধুরী ট্রাষ্ট এর মাধ্যমে অত্র পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, সমগ্র উপজেলায় বৃত্তি আয়োজন ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। মাস্টার সাহেব আমাকে আমন্ত্রণ দিতেন মেধাবৃত্তি প্রকল্প পরিদর্শনের। তাঁদের পারিবারিক ট্রাষ্ট আব্দুন নূর-নুরজাহান চৌধুরী কল্যাণ ট্রাষ্টের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বেতন প্রদান ছিল প্রশংসনীয়।
এলাকায় প্রতিষ্টিত হয়েছে আব্দুন নূর -নূর জাহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় যা তাঁর জীবনে মাইলফলক হিসেবে চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে। আব্দুর নূর মাষ্টার ছিলেন মানুষকে আপন করার এক যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। পতনউষার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনায় তার জ্ঞানগর্ভ কথা বার্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ,সাহসী পদক্ষেপ আজ স্মৃতিপটে।

 যেখানেই যে অবস্থায় যার কাছেই গেছেন তাকেই আপন করেছেন। হয়ে উঠেছেন মানুষের পরমাত্মীয়। একজন নিঃস্বার্থ ও নীতিবান সমাজকর্মী হিসাবে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্দুন নূর মাষ্টার ধর্ম-বর্ণ আর রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে মানুষের সেবা করে গিয়েছেন আমৃত্য। স্কুল পরিচালনায় করতে গিয়ে তাঁহার সান্নিধ্যে থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল আমার। 

পারিবারিক জীবনে আব্দুন নূর মাস্টার একজন সফল স্বার্থক ব্যক্তি। ৪ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর ছেলে-মেয়েরা দেশে বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। বড় ছেলে নজরুল ইসলাম আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্টান পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ভিজিট করে গিয়েছেন এপ্রিল-২০১৯ ইং। দাতা সদস্য 
পরিবারের সদস্য হিসাবে প্রিয় নজরুল ইসলামকে পেয়ে আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যবৃন্দ ও প্রিয় শিক্ষক জমশেদ আলী সহ আমরা স্বল্প সময়ে তাঁহাকে প্রতিটি ক্লাসে নিয়ে গিয়েছি, কম্পিউটার ল্যাব ভিজিট করিয়েছি। বাবার মত হাঁসি মুখে প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথা বলেছেন , স্মৃতিচারণ করছেন তাঁহার ছাত্র জীবন নিয়ে। যতক্ষণ ছিলেন তাঁকে মনে হয়েছে বাবার শিক্ষাই পেয়েছেন।

 সাফল্যকে বিভিন্ন মানদন্ডে মানুষ বিবেচনা করে। একজন শিক্ষক হিসেবে আব্দুন নূর মাষ্টারের জীবনের সাফল্যকে আমি যোগপযোগী হিসাবে দেখছি। আমার ছেলেও ডাক্তারী পড়ছে। নূর মাষ্টারের ছোট ছেলে আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্র ডাঃ শিপুর সাথে আমার ছেলের পরিচয় আছে ,সু-সম্পর্কও আছে। আমার প্রিয় শিক্ষক জমশেদ আলী পারিবারিক ভাবে নূর মাস্টার সাহেবের পরিবারের সাথে সম্পর্কিত যা থেকে আমার জানার সুযোগ হয়েছে। মাষ্টার সাহেবের বড় ছেলে প্রিয় নজরুল ইসলাম দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রয়েল মার্সডেন ক্যান্সার রিসার্স হসপিটালে সিনিয়র ইন্সিডেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। জার্নালিস্ট হিসাবে তিনি বেশ পরিচিত। সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে তিনি চমৎকার আর্টিকেল লেখেন। তাঁর ২য় ছেলে রিপন ইসলাম ময়নুল কমিনিউটি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের পারিবারিক ট্রাষ্ট আব্দুন নুর-নুরজাহান চৌধুরী কল্যাণ ট্রাষ্টের ট্রাষ্টি , সে ২নং পতন উষার ইউপির মেম্বার। নুর মাস্টারের ৩য় ছেলে আমাদের ছাত্র স্নেহাপদ নাজমুল ইসলাম ইমন যুক্তরাজ্যের সান্দারল্যান্ড ইউনিভাসিটি থেকে BA (Hons) International Tourism and Hospitality Management উপর উচ্চতর ডিগ্রী করেছেন। সে কাজ করছে "মোবিলাইজেশন সার্ভিস ম্যানেজার (নন ক্লিনিক্যাল) দ্য ডিপার্টমেন্ট ওফ হেল্থ কেয়ার ফ্যাসিলিটি - লুইসাম এন্ড গ্রীনিস NHS ট্রাস্ট যুক্তরাজ্যে। ছোট ছেলে আমাদের ছাত্র ডাঃ কামরুল ইসলাম শিপু (MBBS) নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজির লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছে। ডাঃ শিপু আইটি এডভাইজার হিসাবেও কাজ করছেন নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডাঃ শিপু মেডিকেলে ছাত্রাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের Access to Information (a2i) Programme প্রকল্পের “বেস্ট ইনোভেটিভ আইডিয়া” প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিল। বর্তমানে ডাঃ শিপু যুক্তরাজ্যের দ্য ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা থেকে “মাস্টার্স ইন্ ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিস” ডিগ্রিতে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন। আমাদের ছাত্রী আব্দুন নূর মাষ্টারের মেয়ে শান্তা সিলেটে দ্য স্কলার হোম ইন্টারন্যাশনাল ও সিলেট ওমেন্স কলেজে পড়া শুনা করেছে। বর্তমানে সে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন। আব্দুন নূর মাস্টারের পুত্রবধু ডাঃ তাহানি আল চৌধুরী (MBBS) নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিপার্টমেন্ট অব এনাটমির লেকচারার। একজন শিক্ষক হিসাবে সহকর্মী শিক্ষকের ছেলে মেয়েদের এমন সাফল্য নিয়ে আমি গৌরববোধ করছি।

প্রয়াতঃ আব্দুন নূর মাষ্টার তাঁহার চার পুত্র ও কন্যাকে এভাবে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশ বিদেশে সু-প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, যারা আজ সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে, সমাজের গরীব দুঃখির পাশে থেকে আর্থিক ও সামাজিক সেবা দিচ্ছেন। নূর মাষ্টার সাহেবের মৃত্যুতে পরিবার হারিয়েছে আপনজনকে, এলাকাবাসী হারিয়েছে একজন সমাজ সংস্কারককে। আজকের দিনে এই শোককে শক্তিতে পরিণত করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেস্ত নছিব করেন, আমিন।

লেখক: ফয়েজ আহমদ 
অধ্যক্ষ 
পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ পতনউষার , কমলগঞ্জ,মৌলভীবাজার।

নোট: লেখাটি সংগৃহীত মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সমাজসেবক সালিশ বিচারক প্রয়াত আব্দুন নূর মাষ্টার নাগরিক শোকসভা, শোক স্মারক "রোদন" থেকে।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন