শুল্ক কমার সুফল নেই বাজারে, উল্টো বেড়েছে চিনি ও খেজুরের দাম

পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে বাকি দুই সপ্তাহেরও কম সময়। রোজার আগে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চলতি মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি চাল, চিনি, তেল ও খেজুরের শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। অথচ গত প্রায় তিন সপ্তাহেও এর সুফল নেই বাজারে। উল্টো বেড়েছে চিনি ও খেজুরের দাম।

 

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছরই শুল্ক কমানোর সুবিধা আমদানিকারকরা পেলেও ভোক্তাদের কাছে সেই সুবিধা পৌঁছে না। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে শুল্ক কমানোর সুফল তাঁরা পাচ্ছেন না। যে পরিমাণে শুল্ক কমানো হয়েছে, তা খুবই সামান্য।

 

যার কারণে বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং ঋণপত্র খোলা (এলসি) নিয়ে জটিলতার কারণে এবার পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি করছেন তাঁরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর যে চার পণ্যের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম শুল্ক কমেছে চিনিতে। চিনি আমদানিতে কেজিতে শুল্ক কমেছে ৬৮ পয়সার মতো।

 

আর খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে সাধারণ মানের খেজুর আমদানি কেজিতে ১৬৪ থেকে কমে ১৩১ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ কেজিতে করভার ৩৩ টাকা কমবে। দামও অন্তত ৩৩ টাকা কমার কথা। সয়াবিন ও পাম তেলে কেজিতে সাত থেকে আট টাকা শুল্ককর কমেছে।

 

চাল আমদানিতে কেজিতে শুল্ক কমেছে সাড়ে ২৩ টাকা। ভোজ্য তেল সয়াবিন আমদানিতে শুল্ক কমানোর পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭৩ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬৩ টাকা করা হয়। যা আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।

নতুন করে বাজারে বেড়েছে চিনির দাম। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে খোলা চিনি কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে চিনির দাম বেড়েছে। গত সোমবার খোলা চিনি কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। যা গত সপ্তাহে প্রতি কেজি খোলা চিনির বিক্রি হয় ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) তসলিম শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে বর্তমানে গত আট থেকে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। এখন একমাত্র ব্রাজিল থেকেই আমাদের চিনি আমদানি করতে হচ্ছে। একটি জাহাজ আসতেই দেড়-দুই মাস সময় লেগে যাচ্ছে। এতে জাহাজ ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। চিনি আমদানিতে নামমাত্র শুল্ককর কমানোর কারণে দেশের বাজারে চিনির দাম কমানো যাচ্ছে না।’

চট্টগ্রাম কাস্টমসের জানুয়ারির শুল্কায়নের হিসাব মতে, প্রতি কেজি চিনিতে আমদানিকারকরা গড়ে শুল্ককর দিয়েছেন ৪০ টাকা ৩৫ পয়সা। এখন শুল্ককরে ছাড় দেওয়া হয়েছে কেজিতে ৬৮ পয়সা। তাতে নতুন করে চিনি আমদানিতে প্রতি কেজিতে আমদানিকারকদের ৩৯ টাকার বেশি কর দিতে হবে।

বাংলাদেশে মূলত অপরিশোধিত চিনি প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয় ১৮ লাখ ৪৮ হাজার টন। তাতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে চার হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। ভোগ্য পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় চিনি থেকে। তাই রাজস্বে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় চিনিতে করভার বেশি কমানো হয়নি বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে আমদানি শুল্কে ছাড় পাওয়া খেজুরের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। অথচ চার পণ্যের মধ্যে খেজুর আমদানিতে সবচেয়ে বেশি শুল্ক কমানো হয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে খুচরায় কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে খেজুর। খুচরা বাজারে সাধারণ মানের খেজুর কেজি ২৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাবাস খেজুর কেজি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, বড়ই খেজুর কেজি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, মরিয়ম খেজুর মানভেদে ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়, মাবরুম খেজুর মানভেদে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৪০০, আজওয়া খেজুর মানভেদে ৯০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, সুক্কারি খেজুর ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় এবং মাসরুক খেজুর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মানভেদে এসব খেজুর আরো বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম এম এন্টারপ্রাইজের হাজী মো. মাঈন উদ্দিন মিয়া বলেন, সরকার ডিউটি কমিয়েছে সত্য কিন্তু বাড়িয়েছিল কত, আর কমিয়েছে কত সেটা দেখতে হবে। আগে এক কনটেইনার ২৫ টন খেজুরে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা ডিউটি ছিল। সেটা বেড়ে হয়েছিল মাঝারি মানের খেজুর এক কনটেইনারে ডিউটি আসে ৬৪ লাখ টাকা। আর যেটা নিম্নমানের সেটার ডিউটি ৩৩ লাখ টাকা। আগে সব একই রকম ছিল। সেখান থেকে বর্তমানে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। ফলে ৬৪ লাখ টাকা শুল্ক কমেছে মাত্র ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এটাকে কমানো বলে না।

মাঈন উদ্দিন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে বাজারে নতুন খেজুর ঢুকছে। তার পর থেকেই দাম বাড়তি। এত দিন পুরনো খেজুর বিক্রি হয়েছে। এ বছর বাজারে খেজুরের সরবরাহ কম। ডিউটি বেশির কারণে ব্যবসায়ীরা কম আমদানি করেছে। আবার এলসি ও ডলার সংকট তো রয়েছে। সব মিলিয়ে দাম বেড়েছে।

জানতে চাইলে রাজধানীর পাইকারি ফলের সবচেয়ে বড় বাজার বাদামতলীর মোল্লা ফ্রেশ ফ্রুটসের ব্যবসায়ী ও ফল আমদানিকারক মো. আল-আমিন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের উচ্চমূল্য ও খেজুর আমদানিতে বাড়তি শুল্কের কারণে এবার বাজারে খেজুরের দাম বেশি। বাড়তি শুল্কের কারণে এবার ব্যবসায়ীরা খেজুর কম আমদানি করেছেন, যার ফলে বাজারেও সরবরাহ কম।’

এদিকে চাল আমদানিতে শুল্ক কমেছে প্রতি কেজিতে সাড়ে ২৩ টাকা। তবে আমদানি মূল্যের চেয়ে বাজারে চালের দাম কম থাকায় আমদানি করতে সাহস পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। এই কারণেই চাল আমদানি বন্ধ রয়েছে।

রাজধানীর চালের পাইকারি সবচেয়ে বড় বাজার বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনের পরপরই চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হলেও সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিয়মিত বাজার অভিযানের কারণে এখন বাজার স্থির রয়েছে। পাইকারিতে কেজিতে দুই-তিন টাকা পর্যন্ত দামও কমেছে। বাজারে পর্যাপ্ত চালের মজুদ থাকায় রমজানে নতুন করে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।’ আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশে চালের বাড়তি দামের কারণে এখন আমদানি হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পণ্য আমদানিকারক থেকে শুরু করে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। এতে জবাবদিহিও নিশ্চিত হবে এবং ভোক্তারা সুফল পাবে। প্রতিবছরই রোজার আগে পণ্যের দাম বাড়ে, তখন আমদানিকারকরা বাজারে পণ্যের দাম কমার কথা বলে শুল্ক কমাতে অনুরোধ করেন। এবারও নানা অজুহাত দিয়ে শুল্ক কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে এর কোনো সুফল আসছে না।’

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন