হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে পুণ্যভূমি সিলেট। বেড়ে গেছে খুন, ধর্ষণ, মারামারি ও ঝগড়া-বিবাদ। স্বজনের হাতে প্রাণ যাচ্ছে স্বজনের। এ অবস্থায় ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন সমাজ বিশ্লেষক ও ইসলামি বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন- পারষ্পরিক মায়া-মমতা উঠে যাওয়া, দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোসহ নানা কারণে পারিবারিক এবং সামাজিক সহিংসতা ও অস্থিরতা সিলেটে সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছ। সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসনের বালাই নেই সমাজে- এ জন্যই সিলেটে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে প্রকাশ্যে ফিল্মি স্টাইলে আক্রমণ করে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। এ ঘট্নায় আহত একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে।
চলতি মাসের ৫ দিনে সিলেট বিভাগে ৪ টি হত্যা, ৩টি আত্মহত্যা, ২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ৩ দিন পর উদ্ধার হয় একজনের লাশ। তিনি চোরাই পথে পণ্য নিয়ে আসতে ভারত গিয়েছিলেন।
১ মার্চ :
গত ১ মার্চ ভোরে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের সারপার বাজারে চোর সন্দেহে পাহারাদারদের মারধরে মখলিছ আলী (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মখলিছ উপজেলার সারপার গ্রামের মৃত আমির আলীর ছেলে। তিনি বেশ কয়েক বছর থেকে ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন। তার ৫ মেয়ে ও ২ ছেলেসহ স্ত্রী শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করতেন। এ ঘটনায় পরে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি।
২ মার্চ :
২ মার্চ সকাল ৭টায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের টিলাগড় গ্রামেটিলাগড় গ্রামের তালেব আলীর মেয়ে সুমা আক্তার (৩১) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পরে পুলিশ এসে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে।
জানা যায়, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের সঙ্গে ৪ মাস আগে বিয়ে হয় সুমা আক্তার। তবে বিয়ের পর থেকে তিনি বাবার বাড়িতে বসবাস করছেন। সম্প্রতি স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিলো না। এজন্য স্বামী তাকে তালাক দেনে। তালাকের খবর পেয়ে সুমা আত্মহত্যা করেন।
একই দিনই ছাত্রদল নেতার লাশ উদ্ধার :
২ মার্চ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করাঙ্গী নদী থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় এক ছাত্রদল নেতার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি জেলার বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। সাইফুল সাতকাপন ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের আব্দুল মালিকের ছেলে। এর ৫ দিন আগে তিনি নিখোঁজ হন।
ওই দিনই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণ :
২ মার্চ হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে মো. আলা উদ্দিন (৩০) নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। পরে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আলা উদ্দিন উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের মো. জহুর আলীর ছেলে।
৩ মার্চ :
৩ মার্চ সকাল ৯টার সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় কিনব্রিজের নিচের একটি বিজ্ঞাপনি সাইনবোর্ড থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় সোহেল মিয়া (৩৮) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। তিনি সবজি ব্যবসায়ী ছিলেন। সোহেল লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার আইয়ানগর গ্রামের মৃত আকবর আলীর ছেলে। তিনি দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা এলাকায় থাকতেন এবং মাদকাসক্ত ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- এটি আত্মহত্যার ঘটনা। ভোরে পথচারীরা লাশটি কিনব্রিজের নিচের একটি বিজ্ঞাপনি সাইনবোর্ডে ঝুলতে দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে তারা এসে ক্র্যান দিয়ে লাশ নিচে নামান।
সোহেল তাঁর পরণের শার্ট দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন তা এখনো জানা যায়নি।
একই দিন জুড়ীতে ধর্ষণ :
৩ মার্চ মৌলভীবাজারের জুড়ীতে কাজের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। পরে এ অভিযোগে ধর্ষক এবং দুই সহযোগীসহ ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। ধর্ষিতা কিশোরী (১৫) পরে জুড়ী থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে সন্ধ্যায় অভিযুক্ত ধর্ষক কামিনীগঞ্জ বাজারের মৃত মস্তফা মিয়ার ছে সামছুজ্জামান রানু মহালদার, ধর্ষণ সহযোগী ধর্ষিতার মা ও উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের বিরইনতলা গ্রামের আত্তর আলীর ছেলে সফিকুল ইসলামকে (৪০) আটক করা হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার কিশোরী এক মাস যাবত অভিযুক্ত রানু মহালদারের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছিলো। একপর্যায়ে কিশোরীর মাকে আয়ত্তে নিয়ে এক মাসে একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করা হয়। সর্বশেষ ১ মার্চও সে ধর্ষণের শিকার হয়। এসময় কিশোরীটি নিজেকে নির্যাতন থেকে রক্ষার্থে সুযোগ পেয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যায় এবং ৪ মার্চ থানায় গিয়ে তিন জনকে আসামী করে ধর্ষণ মামলা দায়ের করে।
৪ মার্চ :
৪ মার্চ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভা নদীর পানিতে ডুবে নিখোঁজ হওয়ার ৩ দিন পর ভেসে উঠে জসিম উদ্দিন (৩৫) নামে একজনের লাশ। তিনি উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির বাখালছড়া গ্রামের ছমর আলীর ছেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানায়, ভারত থেকে চোরাই পথে চিনির বস্তা আনতে গিয়েছিলেন জসিম উদ্দিনসহ ৩ জন যুবক। দেশে ফিরে আসার সময় সীমান্তবর্তী আফারমুখ গলাচিপা নামক এলাকায় লোভা নদী পার হতে গিয়ে নদীর পানিতে তলিয়ে যান জসিম। এ সময় তার সাথে থাকা অপর দু'জন জসিম উদ্দিনকে উদ্ধার করতে পারেননি। পরে ৪ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে নিখোঁজ জসিম উদ্দিনের লাশ লোভা নদীতে ভেসে উঠলে স্থানীয়রা লাশ উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যদের খবর দেন। সংবাদ পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।
একই দিন সিলেটে মামার হাতে ভাগনে খুন :
৪ মার্চ সিলেট মহানগরের শাহজালাল উপশহরে মামার হাতে ভাগনে খুনের ঘটনা ঘটেছে। ওই দিন দুপুরের দিকে শাহজালাল উপশহরের ই-ব্লকের ২ নম্বর রোডের একটি বাসায় এ ঘটনা ঘটে। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
খুন হওয়া মিজানুর রহমান রাফি (২৪) গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জের মাইজগাওয়ের আব্দুল বারীর ছেলে। উপশহর এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি। একই বাসায় থাকতেন তারা মামা, হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত আবু সুফিয়ান (৩৮)। তিনি সিলেটের জকিগঞ্জের বারহাল ইউনিয়নের বোরহানপুর গ্রামের বদরুদ্দিনের ছেলে এবং সোবাহানীঘাটস্থ ট্রেড সেন্টারের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। ভাগনে তার দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। টাকা-পয়সার বিরোধ নিয়ে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ।
৫ মার্চ :
সর্বশেষ ৫ মার্চ সিলেট আদালতে একটি মামলার হাজিরা দিতে আসার পথে অতর্কিত হামলার শিকার হয়ে খুন হয়েছেন বালাগঞ্জের এক যুবক। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার উত্তর কুশিয়ারা ইউনিয়নের রুকনপুর গ্রামের জামে মসজিদের পাশে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলায় জুনেদুল ইসলাম (২৭) নামে এক যুবক ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার ভাই জাহেদুল ইসলামকে (৩৩) আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পরে তাকে প্রেরণ করা হয় ঢাকায়।
জুনেদুল ও জাহেদুল বালাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়নের কলমপুর গ্রামের কনাই মিয়ার ছেলে।
স্থানীয় সূত্র- জুনেদুল ও জাহেদুলসহ কয়েকজন একটি মামলায় হাজিরা দিতে সিএনজি অটোরিকশাযোগে সিলেট আদালতে আসছিলেন। পথিমধ্যে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফেঞ্চুগঞ্জের রুকনপুর গ্রামের জামে মসজিদের পাশে তাদের গাড়ি আসামাত্র ১৫-২০ জন দুর্বৃত্ত তাদের গাড়িটি আটকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত হামলায় চালায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ঘটনাস্থলেই জুনেদুলের মৃত্যু ঘটে।
একই দিন আত্মহত্যা :
৫ মার্চ সকালে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ নতুন বাজারস্থ রামপুর গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে আব্দুল আমিন (৪৮) গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি পেশায় সিএনজি অটোরিকশাচালক ছিলেন। তবে তিনি কী কারণে আত্মহত্যা করেছেন তা সন্ধ্যা পর্যন্ত জানা যায়নি।
সিলেটে বিরাজমান এমন পরিস্থিতি সচেতন মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন সিলেটবাসী।
সিলেটে সহিংসতা ও অস্থিরতার বাড়ার বিষয়ে সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, ‘আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় এটা বলতে পারি, সিলেটে অনেক তুচ্ছ কারণে হত্যাকাণ্ড হয়। আর আসলে আমাদের মধ্যে এখন আর আগের মতো পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন নেই। আপনজনের প্রতি আস্থা, মূল্যবোধ নেই। কেউ কাউকে সাহায্য করতে চান না। তাই স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করছে। স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করছে। ছেলে মাকে হত্যা করছে আর মা ছেলেকে হত্যা করছে। মামা ভাগ্নেকে হত্যা করছে।’
তিনি বলেন, শুধু আইনি শাস্তি দিয়ে এই অপরাধমূলক কাজ থেকে মানুষকে ফেরানো যাবে না। মানুষের এই নৃশংস মনোভাব থেকে উত্তরণের জন্য পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব জায়গা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় সিলেটে এমন ঘটছে- এমনটাই মন্তব্য ধর্মীয় নেতাদের। জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস- কলামিস্ট মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ সিলেটভিউ-কে বলেন, ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করাই এসবের মূল কারণ। ধর্মই অনুপম ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে পারে। আমরা আজ ধর্মীয় আদেশ ও বিধি-নিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পশ্চিমা অপসংস্কৃতিতে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছি, যার কারণে বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতার ও সহিংসতা।
এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ধর্মীয় অনুশাসনে ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই বলে মনে করেন মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন