বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে এবার শ্রীলঙ্কার ব্যাটাররা আর সেভাবে ছুটতে পারেননি, যেভাবে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে তাঁরা ছুটেছিলেন। আগের ম্যাচে ২০৬ রান করা সফরকারীদের সিরিজে ফেরার লড়াইয়ে থামানো যায় ১৬৫ রানে। এই রান তাড়ায় লিটন কুমার দাস আর সৌম্য সরকারের উদ্বোধনী জুটিই জয়ের ছন্দ ধরে দেয় বাংলাদেশকে। ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে-তেই তাঁরা দু’জনে মিলে ঝড়ের বেগে তুলে দেন ৬৩ রান।
যদিও ইনিংস আরো বড় করতে পারেননি দু’জনের কেউই। তবে ১৫ রানের মধ্যে তাঁদের বিদায়ের পর দল পথও হারায়নি। হারাতে না দেওয়া অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও টি-টোয়েন্টিতে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। সদ্যসমাপ্ত বিপিএলে ব্যাট হাতে দুঃসময় পার করে আসা ব্যাটার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও সবশেষ ১২ ম্যাচের ১১ ইনিংসে পাননি কোনো ফিফটির দেখা।
আজ রাতে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তাওহীদ হূদয়ের সঙ্গে ৮৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দলকে জয়ের তীরে ভেড়ানোর পথে কাঙ্খিত সেই ফিফটিও পেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তাও আবার কিভাবে? দাশুন শানাকাকে ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে মারা ম্যাচে তাঁর দ্বিতীয় ছক্কাটিই যে ছিল দলের উইনিং শট। রানে ফেরার ম্যাচে পথ দেখানো অধিনায়ক হয়েছেন ম্যাচের সেরাও। নাজমুলের রানে ফেরার ম্যাচে ১১ বল বাকি থাকতেই ৮ উইকেটের বিশাল জয়ে স্বাগতিকরাও সিরিজে ফেরালো সমতা।
২০০২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে আর কোনো দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজে না হারা বাংলাদেশ এই জয়ে জাগালো আরেক সম্ভাবনাও। তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম ম্যাচ হারার পর এর আগে তাঁরা সিরিজ জিতেছিল একবারই। সেটিও ২০১৮ সালে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে শুরু করার পর শেষ দুই ম্যাচ জিতে সিরিজের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিল বাংলাদেশ। ৯ মার্চ সিলেটে তেমন কিছুরই পুনরাবৃত্তির সুযোগ এখন নাজমুলদের সামনে।
৩৮ বলে ২ ছক্কা ও ৪ চারের মারে ৫৩ রানে অপরাজিত থাকা নাজমুলের সঙ্গী তাওহীদ ৩২ রান করতে খেলেছেন ২৫ বল। নাজমুলের ব্যাটে জয় নিশ্চিত হওয়ার আগের ওভারেই মাহিশ থিকশানাকে মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মেরেছেন ছক্কাও। এর আগে ৬৮ রানের উদ্বোধনী জুটিতে ২৪ বলে ১ ছক্কা ও ৫ চারে ৩৬ রান করেন লিটন। রিভিউ নিয়ে একবার বেঁচে যাওয়া সৌম্য ২২ বলে ৫ চারের মারে করেন ২৬ রান। বাংলাদেশের দুই ওপেনারই বিদায় নিয়েছেন লঙ্কান পেসার মাথিশা পাথিরানার শর্ট বলে। তাঁরা আউট হওয়ার পর নাজমুল-তাওহীদের ব্যাটে অনায়াসেই বাকি পথ পাড়ি দেয় বাংলাদেশ।
আগের ম্যাচে তাঁর ২১ বলের ইনিংসে কোনো বাউন্ডারি না থাকলেও চারিথ আসালঙ্কা ছক্কা মেরেছিলেন ছয়-ছয়টি। তাতে রানের এমন বল্গা হরিণ ছুটেছিল যে শ্রীলঙ্কা পেরিয়ে যায় দুইশো। তাঁদের ২০৬ রান তাড়ায় ৩ রানে হারার দুঃখ চেপে সিরিজ বাঁচাতে নামা বাংলাদেশের বিপক্ষে আবারো চড়াও হতে শুরু করেছিলেন শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। কিন্তু একই ওভারে তাঁর ব্যাটে দুই ছক্কা খাওয়ার পর আসালঙ্কাকে বোল্ড করে শোধ তোলেন শেখ মেহেদী হাসান। ১৪ বলে তিন ছক্কা ও এক চারে ২৮ রান করে তাই থামতে হয় এই মারকুটে ব্যাটারকে। আগের ম্যাচে ফিফটি করা কুশল মেন্ডিস (২২ বলে ৩৬) ও সাদিরা সামারাবিক্রমাদেরও (১১ বলে ৭) বাংলাদেশের বোলাররা থামান অনেক কমে। সুবাদে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে অবাধে রান করা সফরকারীদেরও এবার বশে আনা যায়। ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর আর কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে না হারা বাংলাদেশ দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে লঙ্কানদের থামায় দুইশোর অনেক কমেই। নির্ধারিত ২০ ওভারে তারা ৫ উইকেট হারিয়ে তোলে ১৬৫ রান।
এই ম্যাচে বাংলাদেশের শুরুটাও ছিল দারুণ। নাজমুল হোসেন শান্ত টানা দ্বিতীয় ম্যাচে টস জিতে সফরকারীদের ব্যাটিংয়ে পাঠানোর পর রানের জন্য ছটফট করছিলেন আভিস্কা ফার্নান্ডো। তা করারই কথা। কারণ আগের ৬ বলে যে কোনো রানই করতে পারেননি কোনো। শ্রীলঙ্কার এই ওপেনার তাই মুখোমুখি হওয়া সপ্তম বলে চড়াও হতে গেলেন তাসকিন আহমেদের ওপর। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে মিডউইকেট দিয়ে তুলে মারতে চাইলেও ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে অনেক উঁচুতে ক্যাচ উঠে যায়। ফলো থ্রুতে সেই ক্যাচ হাতে জমাতে কোনো সমস্যাই হয়নি বোলার তাসকিনের। প্রথম উইকেট হারানোর সময় স্কোরবোর্ডে লঙ্কানদের রানও মোটে ১। এর আগে প্রথম ওভার মেডেন দিয়ে শুরু করেন আরেক পেসার শরিফুল ইসলাম। দুয়েমিলে সিরিজ বাঁচানোর লড়াইয়ে বাংলাদেশের এমন শুরুর পর অবশ্য কুশল মেন্ডিস ও কামিন্দু মেন্ডিসের ব্যাটে বিপর্যয় সামলে ওঠার চেষ্টায় গতি ছিল শ্রীলঙ্কারও। পাল্টা আক্রমণেই পথ খুঁজে নিচ্ছিলেন এই দুই ব্যাটার। ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে-তেই তাঁরা স্কোরবোর্ডে জমা করে দেন ১ উইকেটে ৪৯ রান।
ফিফটি পেরিয়ে তাঁদের জুটি যখন স্বাগতিকদের আতঙ্ক বাড়িয়ে চলছিল, তখনই বোলিংয়ে এসে দলকে স্বস্তি দেন সৌম্য সরকার। কুশল মেন্ডিসকে (২২ বলে ৩ ছক্কা ও ২ চারে ৩৬) কট বিহাইন্ড করে ভাঙেন ৪২ বলে ৬৬ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটি। পরের ওভারেই রানআউটে কাটা পড়েন আরেক সেট ব্যাটার কামিন্দু মেন্ডিসও (২৭ বলে ২ ছক্কা ও ৩ চারে ৩৭)। পয়েন্ট থেকে শেখ মেহেদীর থ্রো ধরে স্টাম্প ভাঙেন বোলার রিশাদ হোসেন। দুই মেন্ডিসকে দুই ওভারে হারিয়েই লঙ্কানদের পথ হারানোর শুরু। এরপর আছে মুস্তাফিজুর রহমানের প্রবলভাবে ফিরে আসার গল্পও। নিজের প্রথম ওভারে ১৫ রান দেওয়ার পর অধিনায়ক নাজমুল তাঁকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে ত্রয়োদশ ওভারে আক্রমণে ফিরেই ধরেন শিকার। তাঁর ওভারের দ্বিতীয় বলটি একটু আগেই খেলে ফেলেন সাদিরা সামারাবিক্রমা। সুবাদে ব্যাটের সামনের দিকে লেগে আসা ফিরতি ক্যাচ নিতে ভুল করেননি মুস্তাফিজও। ততক্ষণে ৭ রান করতে ১১ বল খেলা হয়ে গেছে আগের ম্যাচে ৪৮ বলে ৬১ রানে অপরাজিত থাকা ব্যাটারের। এরপর আসালঙ্কার বিদায়ে ১১২ রানে ৫ উইকেট হারানো দলে পরিণথ লঙ্কানদের টানেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ (২১ বলে ৩২*) ও দাশুন শানাকা (১৮ বলে ২০*)। তাই বলে আগের ম্যাচের মতো বাংলাদেশকে বিশাল কোনো লক্ষ্যও দিতে পারেননি তাঁরা। বরং প্রথম টি-টোয়েন্টির খরুচে বাংলাদেশি বোলাররা এবার খুব নিয়ন্ত্রিত। উইকেট না পেলেও শরিফুল ৪ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ২০ রান। অথচ আগের ম্যাচে তাঁর ওভারপ্রতি খরচ ছিল ১১.৭৫ রান। তাসকিন ও মেহেদীদের ওভারপিছু খরচও এবার দশের কম।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন