ভোলায় ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে আশ্রয়কেন্দ্রসহ দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অনেক উন্নতি হলেও এখনো নারীদের জন্য পৃথক টয়লেটের মতো মৌলিক সুবিধার অভাব রয়েছে। নতুন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৃথক টয়লেট থাকলেও স্থানের অভাব ও ব্যবস্থাপনার সমস্যা রয়ে গেছে। দুর্যোগের সময়ে নিরাপত্তা এবং যথাযথ সুবিধার অভাবে ৬৬.৯ শতাংশ নারী ও কিশোরীই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে খুব বেশি আগ্রহী নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব পড়ে তা নিয়ে একটি তথ্য অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)।
বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে এই গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষণার তথ্য অনুসারে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক নারী নীরবে যৌন সমস্যা নিয়েই জীবন যাপন করছেন, যা পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ‘বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগের প্রভাবের ওপর বিভিন্ন খাতভিত্তিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত করা হয়। এতে উঠে এসেছে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, জীবিকার অভাবসহ নানা দিক।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিএম ওয়াচের সহযোগিতায় আইআরসির এই গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলের চারটি জেলার অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এগুলো হলো বরিশাল, ভোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা। গুণগত ও পরিমাণগত পদ্ধতিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভোলা ও সাতক্ষীরায় বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ও বাস্তুচ্যুত মানুষকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে এই গবেষণায়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে মায়েদের জন্য আমরা শিশুদের দুধ পান করানোর আলাদা ব্যবস্থা করেছি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করছি, যেন সেগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিয়া বলল, ‘আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার অভাব বোধ করি। একজন কিশোরী হিসেবে আমি নিরাপদ বোধ করি না।’
আইআরসির কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান বলেন, ‘সব ধরনের লিঙ্গের, জাতির মানুষের সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়ার এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘দুর্যোগে যে মানুষগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে, তাদের অধিকার সম্পর্কে আমরা এখনো সচেতন নই।’
৭৫ শতাংশ মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা পায় না
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ভোলা ও সাতক্ষীরার মানুষের ৫০.৬ শতাংশই সংক্রামক, অতিরিক্ত গরম ও তাপ সংক্রান্ত রোগ এবং শ্বাসতন্ত্রের অসুখসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এসব অঞ্চলের ৭৪.১ শতাংশ মানুষ সঠিক সময়ে চিকিত্সা পায় না।
শিক্ষায় বড় বাধা প্রাকৃতিক দুর্যোগ
ভোলা ও সাতক্ষীরার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শিক্ষা খাতের বহুমুখী চ্যালেঞ্জের চিত্র উঠে এসেছে গবেষণায়। দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী বিশেষ করে প্রান্তিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি।
মেয়েদের বেলায় দেখা গেছে, দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ৮৬.১ শতাংশ ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজের চাপ বেড়ে যায়। ফলে তাদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়। আবার দুর্যোগের সময় ৩০.৯ শতাংশ মেয়ের বই-খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ নষ্ট হয় কিংবা হারিয়ে যায়। দুর্যোগের পরে বাড়তি পাঠ্যপুস্তকের অভাব, দারিদ্র্য, অপর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক, দুর্বল পরিবহনব্যবস্থা এবং দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে স্কুলের ব্যবহার শিক্ষাসেবা ব্যাহত করে।
ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ৪৪ শতাংশ শিশু
শিশুদের সহজাত শারীরিক সংবেদনশীলতা তাদের জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ঝুঁকিতে ফেলে। শিশুদের ওপর দুর্যোগের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে ভেক্টরবাহিত রোগ, অপুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং অভিবাসনে বাধ্য হওয়ার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে ৪৪.১ শতাংশ। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম ৫৪.৪ শতাংশ এবং বাল্যবিবাহ ৩৮.৫ শতাংশ বাড়ে।
লিঙ্গভিত্তিক ও যৌন সহিংসতা
দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যেমন যৌন হয়রানির মতো ঘটনা এতটাই অহরহ ঘটছে যে তা নারী ও শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করছে।
ব্যাহত সামাজিক সুরক্ষা ও আইনের শাসন
দুর্যোগ সামাজিক সুরক্ষা ও আইনের শাসন ব্যাহত করে। দুর্যোগের সময় ও দুর্যোগের পর লুটপাট, সহিংসতাসহ নানা সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় বলে জানিয়েছে ৬১.৩ শতাংশ মানুষ। সচেতনতার অভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে মাত্র ১.৭ শতাংশ প্রাথমিকভাবে আইনি সহায়তা চেয়েছে।
জীবিকার ওপর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ফলে মিঠা পানি ও নদী এলাকা কমার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবিকা প্রভাবিত হয়। ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে যোগাযোগ এবং জীবিকার ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। ৪২.১ শতাংশ ক্ষেত্রে কৃষি উত্পাদনে ক্ষতি হয়।
সুপারিশ
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নয়ন ও ধারাবাহিকতা রক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুবান্ধব স্থান স্থাপন করা, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে লিঙ্গসংবেদনশীল ও নিরাপদ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির সুপারিশও উঠে এসেছে। এ ছাড়া আইন প্রয়োগকারী এবং বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, জলবায়ু সহনশীল জীবিকা এগিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন