সিলেট মহানগরের ১৮ নং ওয়ার্ড এলাকার একটি নর্দমায় পড়েছিলো সদ্যজাত শিশুকন্যার দেহ। একদল কুকুর শিশুটিকে নর্দমা থেকে খাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নিয়ে আসলে তা স্থানীয়দের চোখে পড়ে। স্থানীয় এক নারী শিশুটিকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করেন।
পরে সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এ বি এম জিল্লুর রহমানকে বিষয়টি জানানো হলে তার তত্ত্বাবধানে শিশুটিকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যান ওই নারী।
বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) সকালে সিলেট মহানগরের ঝর্ণাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকাহত করে সেই নবজাতক বৃহস্পতিবারা দিবাগত রাত ১টার দিকে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
ওই সদ্যজাত শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি সিলেটভিউ-কে নিশ্চিত করেছেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী।
তিনি শুক্রবার (৮ মার্চ) সন্ধ্যায় সিলেটভিউ-কে বলেন- একদিন বয়সী শিশুটিকে বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় কাউন্সিলরের তত্বাবধানে ওসমানীতে ভর্তি করেন এক নারী। কুকুরের কামড়ে শিশুর শরীরের বেশ ক্ষত ছিলো। ছিলো রক্তস্বল্পতা। সবমিলিয়ে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে সে মারা যায়।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ঝর্ণাপাড়া এলাকার একটি নর্দমা থেকে একদল কুকুর সেই শিশুটিকে খাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নিয়ে আসলে আমাদের চোখে পড়ে। স্থানীয় এক নারী শিশুটিকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় কাউন্সিলরের তত্বাবধানে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। শিশুটির হাত-পা, পিঠ ও গলায় বেশ কিছু ক্ষতচিহ্ন ছিলো। এমনকি নাড়িও কাঁটা ছিলো না বলে জানান স্থানীয়রা।
তবে কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা এখনও জানা যায়নি।
এদিকে, এই শিশুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনা সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকে মুহ্যমান করেছে। ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এ বি এম জিল্লুর রহমানের স্ত্রী শিক্ষিকা লিনু ফারজানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর ব্যথাতুর কথাগুলো তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছেন-
সদ্য জন্মানো এক শিশু ভেসে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। সিলেট শহরে ছড়া আর ড্রেনের মধ্যে পার্থক্য করা দায়।
নোংরা আবর্জনায় ঠাসা ছড়া থেকে নবজাতককে টেনে ডাঙ্গার কাছাকাছি নিয়ে আসে এক নেড়ি কুত্তা। চার পায়ের প্রাণী। মানুষের মতো হাত নেই যে তার।তাইতো অন্তরে মায়া মমতা থাকলেও নিরূপায় সে। দাঁত দিয়ে কামড় মেরে তোলা ছাড়া উপায় নেই। কুকুরের দাঁতের আঁচড়ে চেঁচিয়ে ওঠে শিশুটি।
অসহায় আর্তনাদ, বাঁচার আকুতি।
স্থান ১৮ নং ওয়ার্ডের নয়া ঝর্নারপার মন্দিরের গলি।
সাত সকালে শিশুর কান্নায় লোক জড় হয়। এক নিঃসন্তান দম্পতিও ছিলেন সেখানে। সবার সহযোগীতায় পরম মমতায় অসহায় শিশুটিকে কাঁথায় জড়িয়ে প্রথমেই প্লাসেন্টা থেকে আলাদা করা হয়।
আকস্মিক ফোন পেয়ে পুত্রকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে পুত্রকন্যাদের পিতা চলে যান ঘটনাস্থলে। ওসমানী হাসপাতালের শিশু বিভাগে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও সেবিকারা শিশুটির চিকিৎসায় মনোযোগ দেন।
অশ্লীল,স্বার্থপর দুনিয়ায় এখনো মানুষেরা বাস করে। সরকারি হাসপাতাল নিয়ে কত নিন্দামন্দ কথা শুনি। অথচ সেখানকার ডাক্তার ও নার্সরা নাম পরিচয়হীন শিশুটিকে জরুরি সেবা দিতে একটুও কার্পন্য করেননি।
কন্যাদের পিতার বন্ধু Mahbub Laskar লিটন ভাইও অসহায় শিশুটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাৎক্ষণিক।
জরুরি ভিত্তিতে রক্ত জোগাড় করে নিয়ে আসেন।
কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সদের চেষ্টার কোন কমতি ছিলোনা।
দুপুর অবধি পুত্রের বাপের নাস্তা খাওয়া হয়নি শুনে ফোন দিলাম।
এমন লোমহর্ষক ঘটনা প্রায়ই শুনা যায়। জানি মানুষ পশুর চেয়ে অধম। তবুও একেবারে নিজের বাড়ির পাশে দুই পাড়া তফাতে এমন ঘটনা আমাকে বড় বেশি পীড়া দিচ্ছে।
আমার মাতৃৃহৃদয়ে তখন তোলপাড় দশা।
মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, শিশুটি যদি এই যাত্রা বেঁচে ওঠে, শিশুটিকে আমিই নিয়ে নিব। কোন নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নিতে চাইলে না হয় ভেবে দেখা যাবে।
শিশুটিকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ ও প্রবল উৎকণ্ঠায় সারা দিন কেটেছে দুই বন্ধুর। বিকেলের দিকে খাবার খেতে পুত্রের বাবা ঘরে ফিরলেও লিটন ভাই তখনো হাসপাতালে।
হঠাৎ ফোন আসে, শিশুটির শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে। আইসিউতে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আইসিউতে জায়গা নেই।
মরিয়া পুত্রকন্যাদের বাবা সিলেট সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ভাইকে ফোন দিলেন।
মেয়র সাহেব সাথে সাথেই শিশুটিকে আইসিউতে নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
শুরু থেকে সাথে থাকা সেই নিঃসন্তান দম্পতি শিশুটিকে দত্তক নিতে প্রবল আগ্রহী।
স্বেচ্ছায় তারাও আছেন শিশুটির পাশে।
গভীর রাতে কন্যাদের পিতা ঘরে ফিরে আসলেও মনে তীব্র উৎকণ্ঠা।
হাসপাতালে বার বার ফোন দিচ্ছেন, খবর নিচ্ছেন।
অবশেষে অপ্রত্যাশিত ফোন আসে, কঠিন দুনিয়ার কঠিন যুদ্ধে পরাজিত শিশুটি।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
লিটন ভাই তখন ওসমানী হাসপাতালে। ঠিক হয় সকালে শিশুটিকে দাফন করা হবে।
দিনভর শিশুটির সাথে থাকা সবার মন খারাপ। ডাক্তার থেকে শুরু করে, নার্স আয়া সবাই।
এই স্বার্থপর দুনিয়ায় এখনো মানুষের বাস আছে।
সকালের ডিউটিতে ফিরে এসে শিশুটির মৃত্যু সংবাদে একজন নার্সও মর্মাহত।
কন্যাদের পিতাকে ফোন দিয়ে বলেন, ভাই, বাচ্চাটার মুখ চোখ থেকে সরছে না, খুব কান্না আসছে।
আমরা শিশুটির কেউ নই, আমাদের সবার কান্না আসছে। বুক ফেটে কান্না আসছে। শিশুটির ফুটফুটে চেহারা ভাসছে খালি চোখের সামনে।
একটা সন্তান, একটা শিশু ও আমাদের অস্তিত্ব একাকার।
অথচ শিশুটির জন্মদাত্রী মা বাবা! তাদের কথা আমি ভাবতে পারছিনা, ভাবতে চাইনা। এদেরকে পশুর সাথে তুলনা করে কুকুর বিড়ালের মাতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইনা।
আমি ভাবতে চাই সেইসব মানুষের কথা যারা ময়লা ভাগাড় থেকে শিশুটিকে পরম মমতায় কোলে তুলে নেন। আমি ভাবতে চাই একজন আব্দুস সাত্তারের কথা যিনি দায় বোধ থেকে প্রথম ফোন দিয়ে খবরটা জানিয়েছিলেন ১৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে।
আমি ভাবতে চাই একজন জনপ্রতিনিধির Zillur Rahman কথা, যিনি সারাদিন অভুক্ত থেকে শিশুটিকে বাঁচাতে মরিয়া ছিলেন।
আমি ভাবতে চাই একজন লিটন ভাইয়ের কথা যিনি অফিস, ব্যবসা, পরিবার ও নিজের কাজ রেখে সারাদিন কাটিয়ে দেন শিশুটির প্রয়োজনে।
আমি ভাবতে চাই সেইসব ডাক্তার, নার্সদের কথা যারা পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মানবিকতার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছেন শিশুটিকে বাঁচাতে। আমি ভাবতে চাই একজন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কথা যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করে শিশুটির জন্য আইসিউ বেড জোগাড় করে দেন।
আমি ভাবতে চাই শিশুটিকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক সেই দম্পতির কথা যারা একমুহুর্তও শিশুটিকে চোখের আড়াল করেননি। সবকিছু শেষ করে রাত তিনটায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ঘরে ফিরেছেন।
অমানুষদের নিয়ে ভাবতে চাইনা, মোটেও ভাবতে চাইনা।
তবুও অমানুষরা আমার আমাদের ভাবনায় আসবেই। শিশুরা ভাসবেই ড্রেনে, ময়লায়, ডাস্টবিনে।
প্রচন্ড চাপ অনুভূত হচ্ছে, চাইলেই কিছু চাপ সরানো যায় না।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন