অবন্তিকাদের অপরাধ : দিনে দিনে ‘মানুষ' শিক্ষক কমে যাচ্ছে!  

নারীর নিরাপত্তা সর্বত্রই শঙ্কায়। পুরুষের এবং পুরুষালী স্বভাবের লোলুপ দৃষ্টির বাইরে নারী এখনো মুক্তি পায়নি! শিক্ষক, সহকর্মী, পথচারী কিংবা পরিচিত-অনেকেই নারীকের বিছানায় চিন্তা করে!

===========================================

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক। 

..........................................................

।।এক।।

মেয়ে হয়ে জন্মানো যে এই সমাজে এখনো অপরাধ সেটা অবন্তিকার জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হলো! নয়তো নিজ শিক্ষক, ক্লাসের সহপাঠী অবন্তিকার মৃত্যুর নিকটবর্তী কারণ কেন হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক তার বিভাগের ছাত্রীকে ভাইভায় শূন্য নম্বর দিয়েছে! যেখানে অন্যান্য সবাইকে দিয়েছে বি! একজন শিক্ষার্থী ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হয়েছেন অথচ তিনি অন্তত এক নম্বর পাওয়ারও যোগ্যতা অর্জন করেননি?-এটা শয়তানেও বিশ্বাস করবে! একজন শিক্ষক ব্যক্তিগত আক্রোশ এভাবে মেটালে সেই শিক্ষক সমাজ ও জাতির কোন উপকারে আসবে? একজন মানুষ কোন পর্যায়ের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গেলে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে?-সেটা ভাবতে পারছেন?এর পরিনাম কল্পনা করুন তো!

 

নারীর নিরাপত্তা সর্বত্রই শঙ্কায়। পুরুষের এবং পুরুষালী স্বভাবের লোলুপ দৃষ্টির বাইরে নারী এখনো মুক্তি পায়নি! শিক্ষক, সহকর্মী, পথচারী কিংবা পরিচিত-অনেকেই নারীকের বিছানায় চিন্তা করে! নারী মানেই তাকে কুপ্রস্তাবে রাজি করানো যাবে, সময় কাটানোর সঙ্গী হবে এবং বিছানায় যাবে-এই মনোভাব থেকে যতদিন মানুষেরা তথা পুরুষ নিজেদেরকে দূরে না সরাবে ততদিনে নারীর নিরাপত্তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে! বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কুপ্রস্তাব দেবে, বাসের সহযাত্রী সুযোগ বুঝে নারীর দেহের দিকে হাত গলাবে, অফিসের বস ভিন্ন প্রস্তাব দেবে এবং আরেকজন সাধু কল্পনার গোপন অভিসার সাজাবে! নারী যেন কেবল কামনার বস্তু। অথচ একজন শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, পরীক্ষার খাতাগুলোতে সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীরা ঢের এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য তবে আমরাই কি বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি?

 

নরপশুদের থেকে অবন্তিকাদের মুক্তি মেলে মরণের ফয়সালায়। এই অবন্তিকার মৃত্যুর প্রতিবাদে গোটা সমাজ যদি বিক্ষুব্ধ না হয়, নীপিড়কদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায় তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক প্লেস এমনকি মসজিদ-মন্দিরেও নারীর নিরাপত্তা অবরুদ্ধ হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পবিত্র আঙিনায় যদি শিক্ষক-সহপাঠীর কাছে শিক্ষার্থী-সহপাঠীনি নিরাপত্তা না পায় তবে বেগম রোকেয়ার সমগ্র জীবনের সংগ্রাম বিফলে যাবে। বর্তমান সরকারের সকল অর্জন ম্রিয়মান হবে। যে জাতির অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী নারী সেই রাস্ট্র যদি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তবে সেই কালিমা রাষ্ট্রের। যারা নারীর প্রগতি, নারী শিক্ষা-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে জোরালো কণ্ঠে সোচ্চার হতে হবে  এবং শক্ত হাতে হায়েনাদের দমাতে হবে।। 

 

এই অবন্তিকারা আমাদের বোন, আমাদের কন্যা। বাবা-মায়ের কাছে যেভাবে অবন্তিকারা নির্ভয়ে নিরাপদ থাকে সেভাবেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র অবন্তিকাদের নিরাপদে চলা-বলা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখতে হবে নারীরপারিপার্শ্বিক পরিবেশ।  চরিত্রহীনরা কোন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হয়ে যায় সে পদ্ধতির আমুল সংস্কার জরুরি। যে বন্ধু তার বান্ধবীর জন্য নিরাপদ ছাতা হতে পারে না, বিশ্বাস অটুট রেখে,  ভরসা স্থির রেখে পাশাপাশি চলতে পারে না- তাদেরকে গঠন করার পরিবেশেরে ত্রুটি-বিচ্যুতি খতিয়ে দেখা উচিত। গলদ কোথায়?-সেটা আবিষ্কার করা খুব জরুরি। 


 

।।দুই।।

যে শিক্ষকের সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতায় কিংবা তার দেওয়া কুপ্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় ছাত্রীকে আত্মহত্যা করতে হয় কিংবা ভাইভায় শূন্য পেতে হয় নতুবা কম সিজিপিএ নিয়ে বিদায় বলতে হয় সেই শিক্ষকের থেকে কেউ কেউ বাড়তি সুবিধাও যে পাচ্ছে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কাজেই কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোন বিশ্বিবদ্যালয়ের কিংবা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের দুর্নামের দায়ভার সমগ্র প্রতিষ্ঠানের! রাজনীতিতে ব্যক্তির দায় দল নিতে না চাইলেও বিবেকের দায় থেকে শিক্ষকের অপরাধের দায় শিক্ষালয় না নিয়ে পারে না! এখানে পচনধরা মানে গোটা জাতিসত্বার পচনের নামান্তর। 

 

দুষ্টের সংখ্যা, মন্দের সংখ্যা খুব অল্পই। তাদেরকে সনাক্ত করে উচিত শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষকসমাজকে কলঙ্কমুক্ত হতে হবে! কোন শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর মতবাদের বিরোধ থাকতেই পারে, পছন্দ-অপছন্দের সম্পর্ক ঘটতেই পারে কিংবা যৌক্তিক বিবাদ হতেই পারে কিন্তু সেটার জের ধরে শিক্ষার্থীকে শূন্য নম্বর দিবে-এটা বর্বরতার চূড়ান্ত। পেশাজীবীর ব্যক্তিগত আক্রোশকে পেশাদারিত্বের সাথে মিশ্রণ করা অপরিপক্কতা। শিক্ষক তো এহেনো কাজ কোনভাবেই করতে পারেন না। তাদের আদর্শের সাথে এটা খাপ খায় না। জাতির যে বিবেক শিক্ষক সেই বিবেকের অংশ এরা নন। এরা মাফিয়া শ্রেণীর। নয়তো এদের অত্যাচারে শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা করতে হবে কেন?  বরং শিক্ষক তো তিনি যিনি মরণ পথযাত্রী শিক্ষার্থীদেরকেও জীবনের পথে ফিরিয়ে আনবেন। আশা দেখাবেন। 


 

।।তিন।।

অবন্তিকারা আমাদের মা-বোন। জাতীয়তার আগামী। অকালে-অপঘাতে তাদের মৃত্যুর কারণগুলোতে শক্তিশালী প্রতিষেধক দিতে হবে। নারীকে আলাদা চোখে দেখতে হবে, কামনায় পুষতে হবে-এমন দৃষ্টিভঙ্গি পদাঘাতে দমন করতে হবে। স্লোগানে স্লোগানে কালপ্রিটদের অবস্থান নাজুক করে দিতে হবে। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রতিষ্ঠানে নিপীড়ন দমনমুলক শক্তিশালী সেল গঠন করতে হবে। যে বোধ নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শেখায়, চারদিকে সেই বোধের চর্চা হওয়াটা খুব জরুরি। অবন্তিকাদের অকালমৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। তাও যদি রাস্তার কোন কুলাঙ্গারের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুতে বাধ্য হতো তাও নবজেকে প্রবোধ দিতে পারতাম কিন্তু সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকের অন্যায্যতা এবং সহপাঠীর বিশ্বাসঘাতকতা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়াটা, আবারও মনে করাচ্ছে-মানুষ হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির বাইরেও আরও বড় কিছুর দরকার হয়। সেই শিক্ষা পরিবার থেকে অর্জন করতে হয়। নিজ চেষ্টা ও চর্চায় বিকশিত হতে হয়। 

 

শিক্ষকের নির্মমতায় যে শিক্ষার্থী ভাইভায় শূন্য পেয়ে অকৃতকার্য অবস্থায় জীবনের কঠিনতম দিনগুলো পাড় করছে তাঁর জীবনটা অচিরেই সহজ করে দেওয়া হোক। মানসিক যন্ত্রনা মানুষকে সাহসী করে গড়ে তোলে!  নয়তো অচিরেই  আমাদের সামনে আরেকজন অবন্তিকার গল্প হাজির হবে। অন্যত্র এই জাতীয় যত কেইস-সমস্যা আছে তা খতিয়ে দেখে মানবিকতার মুক্তি দেওয়া হোক। বিভৎসতা কিংবা নির্মমতারও সীমা থাকতে হয়! হায় একি! মানুষ গড়ার কারিগরেরা এ কোন পথে হাঁটছে? তাদের কেউ কেউ এইসব কী করছে? বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালার বৃহত্তর পরিবর্তন দরকার। শিক্ষকের ক্ষমতায় ও একপেশে আচরণে যে কাউকে প্রথম/দ্বিতীয় বানিয়ে দেওয়া দেখছি মামুলি ব্যাপারো পৌঁছেছে! শূন্য দেওয়ার পুণ্য সে কথাই বলছে! রাস্ট্র সাবধান হোক, জনতার সচেতনতাও জরুরি!  নয়তো দিনে দিনে 'মানুষ' শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাবে! আজকাল কেবল রেজাল্টধারীরা আর সুপারিশবাহীরা শিক্ষক হয়ে উঠছেন! মেধাবীরা-আদর্শবাদীরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে নয়তো ঠায় দাঁড়িয়ে অপকীর্তির কীর্তন দেখছে!

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন