১২ দিন ধরে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে রাখা সোমালি সশস্ত্র জলদস্যুরা কিছুটা চাপে পড়েছে। জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করা নিয়ে তিন দিন ধরে মালিকপক্ষের সঙ্গে দস্যুদের যোগাযোগ চলছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতা নিয়ে যোগাযোগের খবরের মধ্যে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেভাল ফোর্সের একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের কথা।
অন্যদিকে সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাইকারী জলদস্যুদের সঙ্গে স্থলভাগের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে অভিযান শুরু করা হয়েছে।
তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার এবং জাহাজের মালিকপক্ষের তরফ থেকে সামরিক অভিযানের বিষয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করে আসা হয়েছে।
ইইউ নেভাল ফোর্সের ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১৮ মিনিটে এমভি আবদুল্লাহর কাছে তাদের জাহাজ মোতায়েনের তথ্য প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশি জাহাজটি ঘিরে ইইউ নেভির একটি হেলিকপ্টার চক্কর দেওয়ার কথাও জানানো হয়। ইইউ নেভাল ফোর্স যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করলেও শিগগিরই কোনো অভিযানের পরিকল্পনার বিষয়ে জানায়নি।
ইইউ নেভাল ফোর্স এর আগেও জিম্মি জাহাজ আবদুল্লাহ উদ্ধারে অভিযানের আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মতি দেওয়া হয়নি। জানা গেছে, জাহাজ মালিকপক্ষের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ নিয়ে দফায় দফায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছে দস্যুরা। যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এবং সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড স্বশাসিত অঞ্চলের পুলিশের অভিযান নিয়ে হঠাৎ চাপের মুখে পড়েছে তারা।
‘নাবিকরা ভালো আছেন’
জাহাজের মালিক কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেহেরুল করিম গতকাল শুক্রবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নাবিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি, তাঁরা (নাবিক) সবাই সুস্থ ও ভালো আছেন।
পরিবারের সঙ্গে তাঁদের কথা হচ্ছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন ও সোমালিয়ার পান্টল্যান্ডের নুগাল অঞ্চলের পুলিশের অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ মেহেরুল করিম বলেন, ‘এ ব্যাপারে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’
এমভি আবদুল্লাহতে বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া কেউ অভিযান চালাতে পারে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাহাজটি বাংলাদেশি পতাকাবাহী। তাই জাহাজে অভিযান চালাতে গেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমতি লাগবে। বাংলাদেশ সরকার অভিযানের পক্ষে নয়।
সরকার অভিযানের অনুমতি দেয়নি।...প্রথম থেকেই আমরা বলে আসছি শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা। জাহাজে অভিযান পরিচালিত হলে এতে বড় ধরনের ঝুঁকি থাকবে।’
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নাবিকদের মুক্ত করা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে নাবিকদের মুক্ত করার জন্য তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হচ্ছে।’
আবদুল্লাহর অদূরে যুদ্ধজাহাজ
বাংলাদেশ সময় গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১৮ মিনিটে দেওয়া এক্স পোস্টে ইইউ নেভাল ফোর্স ইইউএনএভিএফওআর বলেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে দস্যুতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা হয়েছে, যার মধ্যে একটি এমভি আবদুল্লাহ এখনো জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
ওই পোস্টের একটি ছবিতে দেখা যায়, ইইউ নেভাল ফোর্সের দুজন সদস্য যুদ্ধজাহাজটি থেকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পোস্টে একটি ভিডিও এবং তিনটি স্থিরচিত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ইইউ নেভাল ফোর্সের অপারেশন আটালান্টার মোতায়েন করা যুদ্ধজাহাজটি বাংলাদেশি জাহাজের কয়েক নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে। যুদ্ধজাহাজ থেকে একটি হেলিকপ্টার জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের ওপর দিয়ে উড়ে যেতেও দেখা যায়।
দস্যুদের হাতে দুই বিকল্প : পান্টল্যান্ড পুলিশ
সোমালিয়ার আধাস্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের নুগাল এলাকার পুলিশ বিভাগের কমান্ডার মোহাম্মদ আলী আহমেদ মারদুফের বরাতে বিবিসি সোমালি জানায়, জলদস্যুদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য তাঁরা একটি অভিযান শুরু করেছেন, যাতে তারা ওই এলাকার স্থলভাগ থেকে আর কোনো সহযোগিতা না পায়। পুলিশের পরিকল্পনা হলো জলদস্যুদের আর নিজেদের সংগঠিত করতে না দেওয়া; জাহাজে যারা আছে তারা যাতে তীর থেকে আর কোনো সাহায্য না পায় তা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে সমুদ্রের অংশেও তারা আন্তর্জাতিক বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় আছে।
কমান্ডার মারদুফ বিবিসি সোমালিকে আরো বলেন, জলদস্যুদের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে। হয় তাদের পান্টল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, না হয় মাল্টার জাহাজ এমভি রুয়েনকে জিম্মি করা দস্যুদের পরিণতি বরণ করতে হবে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জাহাজটি উদ্ধার করে জলদস্যুদের আটক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময় গতকাল দুপুর ১টার দিকে বিবিসি সোমালি খবরটি প্রকাশ করে।
অভিযানে সম্মতি নেই বাংলাদেশের
গত ১২ মার্চ সোমালি দস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ আবদুল্লাহ ছিনতাই করার পর থেকে জলদস্যুতা নির্মূলে কাজ করা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স ‘অপারেশন আটালান্টার’ অংশ হিসেবে জাহাজটির ওপর নজর রাখছে। ইউরোপীয় এই বাহিনী এরই মধ্যে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বেসরকারি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন