রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধ নিয়ে সতর্ক জার্মানি?

জার্মানির জনমতকে প্রভাবিত করতে নতুন করে প্রচেষ্টায় রত মস্কো। জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে দেশের জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে ‘হাইব্রিড যুদ্ধের’ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ কী ও কিভাবে এর মোকাবেলা সম্ভব? জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজারের মতে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য সাইবার আক্রমণ, প্রচারণা ও অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করছে রাশিয়া।

মধ্য বামপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য ন্যান্সি ফেজার জুডডয়চে সাইটুং পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এইব বিপদ একটি নতুন স্তরে পৌঁছে গেছে।’

 

আগামী জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং সেপ্টেম্বরে তিনটি আঞ্চলিক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জার্মানি। এমন সময়ই জার্মান জনগণকে সতর্ক করে দিলেন ফেজার। ভোটের আগে রাশিয়া ক্রেমলিনপন্থী দলগুলোর সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা করতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে।

এমন একটি দল হতে পারে ডানপন্থী পপুলিস্ট দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)।

 

জার্মানি বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রভাব বিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সমর্থন হ্রাস করা।

মস্কোতে জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জার্মানির বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট  র‌্যুডিগার ফন ফ্রিটশ বলেছেন, ‘এখন দৃঢ় সংকল্প ও শক্তি দেখানো এবং অন্য পক্ষ কিভাবে কাজ করছে তা প্রকাশ করার সময়।

 

হাইব্রিড যুদ্ধ কী?
‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ শব্দবন্ধটি একটি জটিল কৌশল বোঝায়। সামরিক কৌশলের সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো ও প্রোপাগান্ডাও রয়েছে এর মধ্যে। এটি অবশ্য নতুন কোনো কৌশল নয়। বহু শতাব্দী ধরে বিদেশে জনমত প্রভাবিত করতে এ ধরনের নানা উপায় ব্যবহার করে আসছে বিভিন্ন দেশ।

কিন্তু দুই দশক ধরে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের ফলে এই হাইব্রিড যুদ্ধ এখন অনলাইনেও জায়গা করে নিয়েছে।

‘হ্যাক-অ্যান্ড-লিক’ অপারেশনের অংশ হিসেবে হ্যাকাররা সংবেদনশীল বা গোপনীয় তথ্য চুরি করে কৌশলে সেটা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করে। নির্বাচনে ব্যবহৃত যন্ত্র, সফটওয়্যারেও সাইবার আক্রমণ করা হয়। পাশাপাশি বানোয়াট বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।

 

ফন ফ্রিটশ বলেন, ‘এখন গোয়েন্দাদের জন্য ডিজিটাল বিশ্ব স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ঘটনায় পরিণত হয়েছে।’

এই যুদ্ধ কিভাবে কাজ করে?
হাইব্রিড যুদ্ধকে অনেকে ‘ছায়া যুদ্ধ’র একটি রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। এই যুদ্ধ জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে ঘটে এবং কখনোই এই যুদ্ধের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় না।

হামবুর্গভিত্তিক ক্যোরবার ফাউন্ডেশনের রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লেসলি শ্যুবেল বলেন, ‘হাইব্রিড যুদ্ধের ধারণাটি হচ্ছে, এটি যে ঘটছে তা আপনি খেয়ালই করবেন না।’

জানুয়ারিতে জার্মান সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে রাশিয়ার একটি সমন্বিত প্রোপাগান্ডামূলক কর্মকাণ্ড উন্মোচন করার কথা জানিয়েছিল। এই প্রোপাগান্ডা বন্ধ করার আগেই বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১০ লাখেরও বেশি বার্তা ছড়ানো হয়েছে। এসব বার্তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে দেওয়া সাহায্য স্থানীয় নাগরিকদের কাছে পৌঁছচ্ছে না—এমন মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব তথ্য ছড়ানোর লক্ষ্য হলো জার্মান সমাজে বিভাজন ও ক্ষোভ সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করা।

শ্যুবেল বলেন, ‘সন্দেহ তৈরি করতে এরই মধ্যে সফল হয়েছে রাশিয়া।’

‘টাউরুস কথোপকথন’ ফাঁসের প্রভাব
এদিকে হাইব্রিড যুদ্ধের অধিকাংশ অপ্রকাশ্যে থাকলেও কিছু অপারেশন ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ করা হয়। একই ঘটনা ঘটেছে টাউরুস ক্ষেপণাস্ত্রকে কেন্দ্র করে। মার্চের শুরুতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী আরটি জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি গোপন কথোপকথন প্রকাশ করে। ‘টাউরুস লিক’ নামে পরিচিত এই কথোপকথন জার্মান সামরিক বাহিনীকে বেশ বিব্রত করে এবং এ নিয়ে একটি কূটনৈতিক জটিলতাও তৈরি হয়।

 

বার্লিনভিত্তিক থিংকট্যাংক সেনট্রুম লিবেরালে মডার্নের রাশিয়া প্রোগ্রামের প্রধান মারিয়া সানিকোভা-ফ্রাংক বলেন, ‘এই ঘটনাকে পুতিন নিজের দেশেও কাজে লাগিয়েছেন।’

ফাঁস হওয়া কথোপকথনে জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক করতে শোনা গেছে। রুশ গণমাধ্যম এরপর দাবি করেছ, জার্মানির সেনাবাহিনী রুশ অঞ্চলে আক্রমণ করার জন্য পরিকল্পনা করছে।

সানিকোভা-ফ্রাংক বলেন, ‘(পুতিন) যে ভাবমূর্তি তৈরি করতে চান তা হলো, জার্মানি ও পশ্চিমারা রাশিয়াকে হুমকি দিচ্ছে। তিনি এই প্রচার করতে খুব সফল হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আলেক্সাই নাভালনির মৃত্যু ও শেষকৃত্য থেকেও সফলভাবে সবার মনোযোগ সরাতে পেরেছেন।’

রাশিয়ায় পুতিনের প্রতিপক্ষদের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্টভাষী ছিলেন নাভালনি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ৪৭ বছর বয়সী এই রুশ রাজনীতিবিদ রাশিয়ার কারাগারে মারা যান। ১ মার্চ তাঁকে সমাহিত করা হয় এবং একই দিনে জার্মানির এই গোপন সামরিক কথোপকথন প্রকাশ করা হয়।

কিভাবে এই যুদ্ধ মোকাবেলা করা যায়?
হাইব্রিড যুদ্ধ মোকাবেলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশগুলোকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, ভোট প্রযুক্তি সাইবার আক্রমণ থেকে পর্যাপ্তভাবে সুরক্ষিত।

‘টাউরুস কথোপকথন’ ফাঁস থেকে বোঝা গেছে, সমাজের সব ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি কতটা প্রয়োজনীয়। নাগরিকদের বিভ্রান্তিমূলক কৌশল সম্পর্কে সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতারণা ও প্ররোচিত করার জন্য অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য কিভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটিও সবাইকে জানানো জরুরি বলে মনে করেন তাঁরা।

সানিকোভা-ফ্রাংক মনে করেন, ‘এই প্রচারের প্রক্রিয়াগুলো প্রকাশ করাটা গুরুত্বপূর্ণ—এটি কিভাবে কাজ করে, কিভাবে এটি আমাদের প্রভাবিত করে, কিভাবে এটি আমাদের মতামতকে প্রভাবিত করে।’

জিবিডেস্ক //

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন