রাজধানীর শান্তিনগরে যানজটে আটকে আছে অনেক বাস। সেগুলোর একটি ভিক্টর ক্লাসিকে এক মধ্যবয়স্ক যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া আদায়কারীর তুমুল তর্ক চলছে। এর কারণ পাঁচ টাকা। যাত্রী বলছেন, পল্টন থেকে রামপুরার ভাড়া ১৫ টাকা।
আর ভাড়া আদায়কারীর দাবি ২০ টাকা দিতে হবে।
ঢাকার বাসগুলোতে এমন দৃশ্য নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই গণপরিবহন ব্যবহারকারীরা এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে থাকে। যেখানে পাঁচ টাকার সমাধান মেলা কঠিন, সেখানে তিন পয়সার খোঁজ কে রাখে! গতকাল মঙ্গলবার সারা দেশে বাসের নতুন ভাড়া কার্যকর হয়েছে।
যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে তিন পয়সা ভাড়া কমানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় বাসের ভাড়ায় এর কোনো প্রভাব নেই। বাড্ডায় আকাশ পরিবহনের এক বাসের শ্রমিক মানিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ভাড়া কমছে এমন কিছু জানি না।’ তাঁর উল্টো প্রশ্ন, ‘আপনি শুনলেন কোথায়?’ পরে আলোচনার এক পর্যায়ে মানিক হেসে বলেন, ‘এটা কেমনে সম্ভব! অনেক সময় আমরা দুই-পাঁচ টাকা এমনিই ছেড়ে দিই।
কিন্তু ২০-৪০ পয়সার হিসাব কেমনে করুম?’
পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাসের ভাড়ায় তিন পয়সার প্রভাব খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নেই। একজন যাত্রী ১০ কিলোমিটার ভ্রমণ করলে ৩০ পয়সা কমবে। এই ভাড়া সমন্বয় করা অবাস্তবিক। ৩৩ কিলোমিটার ভ্রমণ করলে এক টাকা ভাড়া কমবে। ঢাকায় কতজন যাত্রীর গন্তব্যের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার? আর এমন বড় রুট আছে কয়টি?
আগেও বাসের ভাড়া এমন হারে কমানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অনুমোদিত কমিটি।
পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতি বিআরটিএর চেয়ারম্যান। তবে পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও কমিটির অংশ হয়ে বাসভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেন।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে কম দূরত্বের পথে ভাড়া কমার সুফল মেলা কঠিন। দূরপাল্লার যাত্রীদের ক্ষেত্রে বাসের ভাড়া কিছুটা কমবে। নতুন ভাড়ার তালিকা দু-এক দিনের মধ্যে বাসে দিয়ে দেওয়া হবে। তখন যাত্রীরা তালিকা দেখে ভাড়া দিতে পারবে।
এর আগে ২০১১ সালে বাসের ভাড়া দুই পয়সা কমিয়েছিল সরকার। ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের মূল্য কমায় বাসের ভাড়া তিন পয়সা কমানো হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বাসের ভাড়া পাঁচ পয়সা কমেছিল। কখনোই কমতি ভাড়ার সুফল যাত্রীরা পায়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রীদের বঞ্চিত করে বাস মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তিন পয়সা ভাড়া কমানোর ফলে যাত্রীরা কোনো সুফল পাবে না। কিন্তু পরিবহন মালিকরা ঠিকই জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল ভোগ করবেন।
এদিকে বাসে এখনো অবৈধ ওয়েবিল প্রথা চালু রয়েছে। ঢাকার লোকাল বাসে ওয়েবিলের নামে কোথাও কোথাও দুই কিলোমিটার পথের জন্য ১৫ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে যখন বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়, তখনই সিটিং সেবা ও ওয়েবিল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সড়কে ওয়েবিল এখনো চলমান।
মূলত বিভিন্ন জায়গায় থামিয়ে বাসে কত যাত্রী আছে সেটা একটা নির্দিষ্ট কাগজে লিখে রাখার প্রথাকে ওয়েবিল বলা হয়। এই ওয়েবিল পদ্ধতি ‘চেকার’ ও ‘চেকিং পয়েন্ট’ নামেও পরিচিত। ওয়েবিলের জায়গার ওপর ভিত্তি করে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এতে কিলোমিটারপ্রতি নির্ধারিত ভাড়ার হিসাব থাকে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর আজিমপুর থেকে একটি বাস নীলক্ষেত, আসাদগেট, খামারবাড়ি, বিজয়নগর, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, বনানী, কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, টঙ্গী হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যায়। একজন যাত্রী যদি আজিমপুর বা নীলক্ষেত থেকে ওই বাসে উঠে খামারবাড়ি বা বিজয়নগর যায় তাহলে তাকে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। আবার আসাদগেট থেকে উঠলেও ২০ টাকাই ভাড়া দিতে হয়। যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন, আসাদগেট থেকে বনানী পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। বনানী পার হলেই এই ভাড়া হয়ে যায় ৪০ টাকা।
ওয়েবিল ও বাসের ভাড়া কমানো নিয়ে কথা হলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মাহাবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ওয়েবিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সমিতির পক্ষ থেকে মালিকদের এটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তিন পয়সার জন্য বাসের ভাড়া কমানোর কোনো সুযোগ নেই। তবু কোনো যাত্রী চাইলে তাঁকে এক টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে।
জিবিডেস্ক //
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন