চাঁদ দেখাতেই বন্দী যাদের ইদের খুশি!

শহর-বন্দরের সর্বত্রজুড়ে লেগেছে শেষমুহূর্তের কেনাকাটার ধুম------

------------------------

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক। |

 

কুহেলির অন্ধকার হঁটিয়ে হাসি-আনন্দের পয়গাম নিয়ে ইদের চাঁদ উঠি উঠি করছে। শাওয়ালের একফালি বাঁকা চাঁদ ধরাবাসীর জন্য পূর্ণত্তোম আনন্দের বার্তা নিয়ে আগমনের প্রতীক্ষায়। সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি-ধরা ঝড়ায়ে গো/বরষের পরে আসিল ঈদ !’ ইদের আগমন ঘটবে অথচ আমাদের নতুন পোশাক হবে না-এটা যেন মানার নয়  তাইতো ইদকে সামনে রেখে দেশব্যাপী কেশাগ্র থেকে নখাগ্র অর্থ্যাৎ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য নতুন কিছু কেনার আয়োজন চলছে।

 

 শহর-বন্দরের সর্বত্রজুড়ে লেগেছে শেষমুহূর্তের কেনাকাটার ধুম। অবশ্য অনেকে ইদ কেনাকাটা মধ্য রমজানের পূর্বভাগেই শেষ। নতুন জামা, নতুন শাড়ী-সবকিছুতেই কেবল নতুনের সমারোহ। ইদের আনন্দকে পূর্ণতা দিতে এ যেন এক বাউলা সমীরণ। চারদিকে কেবল নতুনের জয়গান। ওয়ারড্রপ, আলমিরা ভর্তি ডজন ডজন নতুন পোশাক, যার অধিকাংশের ভাগ্যে এখনো ত্বকের স্পর্শ জোটেনি, তারপরেও ইদ উপলক্ষে আরও নতুন কিছু কেনা-পাওয়ার অবিরাম চেষ্টা। 

 

ইদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরাও নতুন করে সব কিছুর পসরা সাজিয়েছে। কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে চিরচেনা শহরগুলো যেন নতুন খোলসে জড়িয়েছে। সেমাই প্রস্তুতালয়গুলোতে শ্রমিকদের মুহূর্তুকাল বিশ্রাম নাই। ইদ আগমনের আগেই চারদিকে শুধু উৎসব উৎসব রব । গ্রামের কিংবা শহরের বর্ণিল জীবন থেকে অনেকটা দূরে অবস্থানরত লোকজন শহরের পানে ছুটছে নতুন কিছু কেনার আশায়। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শহর-নগরের অভিজাত শপিংমলগুলোতে প্রবেশাধিকার হয়তো সামর্থের বাইরে কিন্তু ফুটপাতের সস্তা দরের দোকানগুলো তাদের আহ্লাদকেও পূর্ণতা দিচ্ছে।  

 

এই সবকিছু মিলেই ইদের আনন্দ, ইদের পূর্ণতা। তারপরেও প্রশ্ন অবশিষ্ট থেকে যায়, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষে মানুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে, বৈষম্যবাদীদের সৃষ্ট জঞ্জাল সরিয়ে আমরা কি সবার জন্য সাম্যের মন্ত্রে, মানবতার দীক্ষায় পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করার উপলক্ষ সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছি? দূর করতে পেরেছি আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্ব? কেবল মানুষ পরিচয়ে আমির-ফকিরকে কি মানবতার মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড় করাতে পেরেছ ?

সমাজবিজ্ঞানীদের বিভাজিত উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং তুলনামূলক নিম্নবিত্তের সাথে আমাদের সমাজে আরও এক শ্রেণীর মানুষ বাস করে, যাদের অবস্থান চরম দারিদ্র্যসীমারও নিচে। হতদরিদ্র বলতে যা বুঝায় এরা বোধহয় তাই। এদের ভাগ্যই সর্বদা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর খেলায় মত্ত । আমাদের চারপাশে এদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় । এদের দৃষ্টিসীমার আকাশেও প্রতিবছর ইদের নতুন চাঁদের উদয় ঘটে কিন্তু কখনোই মনে খুশির রঙ ধরা দেয় না। শুধু ইদের চাঁদ দর্শনেই বন্দী থাকে তাদের খুশির রঙ। সে রঙ বিবর্ণ-ফ্যাকাশেও বটে।  ঈদের আনন্দে শামিল হতে নতুন পোশাক অঙ্গে চাপানো তো দূরের কথা, বরং এদের সামর্থ্য বারবার জানিয়ে দেয় নতুন পোশাকের কল্পনাও তাদের জন্য পাপ সমতুল্য ! ইদের সকালে একটু মিষ্টান্নের সংস্থান করতেই এরা হাপিয়ে ওঠে কিংবা কারো অনুগ্রহ লাভের আশায় তাকিয়ে থাকে। 

 

সংখ্যায় ১৬ কোটির অধিক মানুষের আবাসের এদেশে চরম দারিদ্র্যপীড়িত কিংবা প্রকৃতির আঘাতে বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীর মুখে হাসি ফোটানো খুব বেশি কঠিন কোন কাজ নয়। শুধু সবার প্রতি সবার ভ্রাতৃপ্রতীম মানসিকতার পরিচয় দিয়ে একটুখানি সহমর্মিতার আদর্শে, কিছুটা ত্যাগের মানসিকতায় আমরাই ছিন্নমূল শিশু, বস্তির অসহায় বৃদ্ধ এবং চরম দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় অবস্থানরত মানুষের মনে উৎসবের রঙ ছড়াতে পারি। এজন্য এককভাবে বড় অঙ্কের সাহায্যেরও প্রয়োজন পড়ে না বরং শধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামর্থ্যের সম্মিলিত অংশগ্রহন এবং সেবাধর্মী মানসিকতাই যথেষ্ট। ধর্ম এবং মানবতা আমাদের নিয়ত সেই শিক্ষাই দেয়, যা মানুষের মধ্যকার বৈষম্য ঘুচিয়ে সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মহিমান্বিত সুযোগ তৈরি করার বার্তা নিয়ে আমাদের দুয়ারে দাঁড়ায়।

 

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং ভাগ্যবান সম্পদশালী হিসেবে এমন মহৎ কাজে অংশগ্রহনের সুযোগ থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করার মানসিকতা কেবল মানসিকতায় ক্ষুদ্ররাই দেখাতে পারে। সুতরাং আমরা প্রত্যেকেই যদি স্বসাধ্য অনুযায়ী সম্মিলিত কিংবা একক প্রচেষ্টায় কোন এক কিংবা একাধিক অসহায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারি তবে তারচেয়ে মহোত্তম কর্ম মানজীবনে আর কী হতে পারে?  বাঁচতে যদি হয় তবে সাম্যের স্লোগান তুলে প্রকৃত মানুষ পরিচয়েই বাঁচি। যে সম্পদে গরীবের নৈতিক অধিকার রয়েছে সে সম্পদ অমানবিকভাবে কুক্ষিগত করে রাখলে তাতে মুক্তি মিলবে কি? 

 

আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের ইদ উপলক্ষে নানাদিকের সম্পর্ক থেকে হালি হালি দামি দামি নতুন কাপড় উপহার হিসেবে আসবে। অথচ এই দেশে হাজারাও মানুষ অবশিষ্ট থাকবে যাদের সন্তানদের কয়েক বছরের পুরাতন ছেঁড়া কাপড় কিংবা উধোল শরীরে ইদের দিনকে বরণ করতে হবে। তাদের জন্য আমাদের কি একটু মানবিক হওয়া উচিত নয়? সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে যদি গৃহভৃত্য থেকে শুরু করে অন্নহীনে অন্ন এবং পোশাকহীনে একটুকরা নতুন পোশাক কিংবা আমাদের সন্তানদের ব্যবহৃত পোশাক থেকে দু’একটি দানের মোড়কে উপহার দিতে পারি তবে জান্নাতি আবহ কি ধূলা-মাটির ধরাতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়? আসুন বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি, গরীব-অসহায়দের জন্য এই ইদে আমাদের করণীয় কি?


 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন