সত্যিকারের মুখোশ কোন বাহ্য আবরণ নয়! 

মুখোশের আড়ালে আপন থাকে, পর থাকে। বন্ধু থাকে, সহকর্মী থাকে এমনকি সহমর্মিও থাকতে পারে। মুখোশধারী বিশ্বাসঘাতকের কাছে যে একবার ঠকেছে সে সরলকে বিশ্বাস করতেও ভয় পায়। সাধু থেকেও সে শয়তানে গন্ধ পায়।

রাজু আহমেদ।  কলাম লেখক। |

সেই মুখোশ সামান্যই যেটা করোনাকালে সবাই পরেছিল কিংবা আমার ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলে এখনো পরে থাকে যাতে ওরা নির্বিঘ্নে নিজেরা নিজেরা কথা চালাচালি করতে পারে! পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় যে মুখোশ জড়াবো কিংবা মুখ ঢাকতে যে মুখোশ পরিধান করি সেটা ক্ষণিকের! আসল মুখোশ তো আমার পরেই আছি! মনের মধ্যে এক রকম চিন্তা পুষছি অথচ মুখে আরেক কথা বলছি! ধর্মকর্ম পালন করছি আবার ঘুষ-দুর্নীতিতেও আছি! নীতিকথা বলতে বলতে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহন করছি! মনের মধ্যে কুচিন্তার পাহাড় জমিয়ে মুখের হাসিতে সাধুবেশ সাজিয়ে রেখেছি-মুখোশ তো আসলে এগুলোই। 

 

ভন্ডামির মুখোশ কাপড়ে-প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি নয়। সে মুখোশ মাটি-কাঠ দিয়ে শক্ত করে বানাতে হয় না! প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটা না রাখাই মুখোশ, কারো বিশ্বাস সচেতনভাবে নষ্ট করাই মুখোশ এবং কারো ভরসা হেলায়-খেলায় ফুরিয়ে দেওয়াই মুখোশ। এই যে কথা দিয়ে কথা না রাখা, কাউকে ঠকানো, সুযোগ পেলেই কারো ক্ষতি করা কিংবা কারো ব্যথায় খোঁচা মারা-এসবই আসল মুখোশ। বাইরের ছাপে সারল্য জিইয়ে রেখে ভেতরে ভেতরে যে কুটচাল, ষড়যন্ত্র  কিংবা অপকৌশল-যা মানুষ সাধারণভাবে ধরতে পারে না সেটাই মুখোশ। মানুষের এই মুখোশ ছিন্ন হয়ে যখন আসল চরিত্র বেরিয়ে আসে তখন মানুষ আঘাত পায়। মনের ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে।  বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে - এটাই তো বড় ক্ষতি!

 

এই মুখোশের জন্যই আমরা মানুষ চিনতে ভুল করি। অপরূপ সৌন্দর্যের ঝলকে আমাদের অপলক করে। মিষ্টি কথার ছলনায় আমরা খেই হারাই। প্রশংসা এবং প্রলোভনের ফারাক বুঝতে পারি না বলেই আমরা ভুলপথে ভুলজনের সাথে হারিয়ে যাই। এইযে মুখোশের আড়ালের মানুষগুলো, যার পদে পদে আমাদের ঠকায়, হৃদয় পোড়ানো ব্যথা দেয় এবং ইচ্ছা করে ভোগায় তাদের আমরা চিনে উঠতে পারি না। বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে যারা স্বপ্ন ডাকাতি করে, যারা আপন সেজে বেদনার ঢেউ তোলে সেই মুখোশে জীবনভর মানুষ আটকে থাকে।  এক জীবনে মানুষ চেনা হয়ে ওঠে না! 

 

মুখোশের আড়ালে আপন থাকে, পর থাকে। বন্ধু থাকে, সহকর্মী থাকে এমনকি সহমর্মিও থাকতে পারে। মুখোশধারী বিশ্বাসঘাতকের কাছে যে একবার ঠকেছে সে সরলকে বিশ্বাস করতেও ভয় পায়। সাধু থেকেও সে শয়তানে গন্ধ পায়। মানুষ আসলে মানুষকে চিনে উঠতে পারে না। একজীবনের পরেও প্রশ্ন ওঠে, আমি কি চিনেছি তোমারে? মানুষ যাদেরকে বাহ্যরূপে চেনে তাদের কেউ আউলিয়া, কেউ দরবেশ, কেউ সাধু আবার কেউ সন্দেশ! মুখোশ থেকে বেরিয়ে এলেই ওই তাদের মাঝেই  দানবের সাক্ষাৎ পাই। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে দিতেও দু'বার ভাবে না! 

 

মানুষের এই মুখোশ আছে বলেই পাশাপাশি থাকা যায়! নয়তো কবেই মানবজাতির ইতি ঘটতো! মনের রূপ, চরিত্রের শোভা যদি নগ্ন হয়ে যেতো তবে ঘৃণা-লাজে মানুষ ডাইনোসরদের অনুসারী হতো! ভেতরের চিন্তাকে যে মুখোশ আড়ালে রেখেছে সে মুখোশ করোনকালের মুখোশের মতোই মানুষের জন্য উপকারী! নয়তো মানুষ মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতো না! ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির সাথে যদি বাস্তবতার তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎ হতো তবে কবেই মানুষের ওপর থেকে অপরাপর মানুষ শাসনভার হারাতো! সম্মান উবে যেতো সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার অনেক আগেই! 

 

আলোতে যে আচরণ করে সেটা মানুষের মুখোশ! আঁধারের মানুষ, আড়ালের মানুষ থেকে মানুষকে জানা যায়! গোপনে সে কি বলে, নিন্দায় সে কতটুকু নামে, মিথ্যায় সে কতখানি ডোবে এবং অভিনয় সে কতটুকু পারে-এসব মুখোশ থেকে মানুষ চেনায়! সামনে প্রশংসা করে প্রিয়জন সেজে থাকা চরিত্রটিই যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ভুলে যায় তখনকার রূপ মুখোশের বাইরে আসল রূপ! আমরা অবভাসের ছায়াটুকু দেখি। যা দেখি না তাই বাস্তব। গুহার রুপকের বাইরে যে সত্য সেটা মুখোশ, যা আমাদের থেকে সত্যকে আড়ালে রেখেছে। দিবালোকও কখনো কখনো মুখোশ পরে থাকে! আঁধার ভেদ না করে সে আড়ালেই ডাকে! দুনিয়ায় কারোরই সবটুকু মুখোশ উন্মোচিত হবে না; হওয়া উচিতও নয়। বিশ্বাস হারানো যে পাপ- এখানে সেই পাপকে জিইয়ে রাখতে হবে!

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন