ইসরায়েলে ইরানের হামলা: উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য, উদ্বেগে বিশ্ব

গাজায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের জেরে এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ইরান গত কয়েক দিনের গুঞ্জনকে সত্য প্রমাণিত করে চিরশত্রু ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা করে বসায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। ইরানের হামলার জবাব কিভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে ইসরায়েল তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রকাশ না করে সংক্ষেপে শুধু বলেছে, এ জন্য ‘যথাসময়ে মূল্য আদায় করা হবে’। এ অবস্থায় জাতিসংঘ, ইসরায়েলের প্রধান দুই মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্য বিশ্বশক্তিগুলো বড় ধরনের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে।

 

স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে ইসরায়েলে তিন শর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। তেহরান বলেছে, সিরিয়ায় তাদের কনসুলেটে গত ১ এপ্রিলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব এটি। ইসরায়েল স্বীকার না করলেও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ সবাই কার্যত নিশ্চিত এটি তাদেরই কাজ। ওই হামলায় ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নিহত হন।

 

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো দেশটির ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালাল ইরান। এত দিন ইরান মূলত তার মদদপুষ্ট হামাস বা হিজবুল্লাহকে দিয়ে ইসরায়েলবিরোধী সামরিক কার্যকলাপ চালাচ্ছিল। বিশ্লেষকরা এই হামলার ঘটনাকে তাই ‘ঐতিহাসিক’ ও নজিরবিহীন বলে আখ্যা দিয়েছেন।

ইরানের নিক্ষেপ করা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই ইসরায়েলের মাটিতে পড়ার আগেই ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী।

 

তেল আবিব বলেছে, এই হামলায় ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের নেভাতিম বিমানঘাঁটি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ইরান সেখানে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার দাবি করেছে। এ ছাড়া একটি বেদুইন শিশু আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।

ইরান বলছে, নেভাতিম বিমানঘাঁটি থেকেই সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে তাদের কনসুলেটে হামলা চালানো হয়েছিল।

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষার সক্ষমতার প্রমাণ

ইসরায়েলের শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা দৃশ্যত সফলভাবে প্রায় সব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঠেকিয়ে দিয়েছে।

 

অন্যথায় এতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমাবাহী ড্রোনে ব্যাপক ধ্বংস ও হতাহত হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমা নেতা ও সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনা ইরানের তুলনায় ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ, বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষায়। তবে অন্যদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিমান ও নৌবাহিনীও ইরানের নিক্ষিপ্ত অস্ত্র ধ্বংসে সহায়তা করেছে।

বদলা নেওয়ার হুঁশিয়ারি ইসরায়েলের

ইরানের অতর্কিত হামলা ও গাজার রাফাহ শহরে অভিযান নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গতকাল সোমবার একটি বৈঠক করেছে। স্থানীয় সময় গতকাল বিকেলে শেষ হওয়া ওই বৈঠকে ইরানের হামলার জবাব দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু ঠিক কিভাবে এবং কখন জবাব দেওয়া হবে তা নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বেনি গ্যান্টজ ইরানের আক্রমণের দ্রুত জবাব দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ধীরেসুস্থে কোনো সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন।

ইরানের হামলার সম্ভাব্য জবাব নিয়ে আলোচনার জন্য ইসরায়েলের পাঁচ সদস্যের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গত রবিবার থেকে একাধিক বৈঠকে বসেছে। মধ্যপন্থী মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ রবিবার বলেছিলেন, তাঁর দেশ ‘সঠিক সময়ে’ ইরানের কাছ থেকে ‘মূল্য আদায় করে’ নেবে।

প্রতিশোধ নিলে ‘বড় হামলার’ হুঁশিয়ারি ইরানের

ইসরায়েল কোনো প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা করলে ‘আরো অনেক বড় পরিসরে’ হামলার মধ্য দিয়ে এর জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। গত রবিবারই এ কথা বলে ইসরায়েল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছে তেহরান। ইরান বলেছে, তার প্রতিশোধমূলক হামলা আপাতত এখানেই শেষ। তাদের হামলার উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে।

হামলার পরপর ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি বলেন, ‘ইসরায়েল যদি ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়, তাহলে আমাদের জবাব আজ রাতের সামরিক পদক্ষেপের চেয়ে অনেক বড় হবে।’ ইসরায়েলকে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে সাহায্য করলে সিরিয়া ও ইরাকের মতো স্থানে মার্কিন ঘাঁটিগুলোও হামলার শিকার হতে পারে বলে সতর্ক করে দেন তিনি।

ইরানে পাল্টা হামলা নিয়ে ওয়াশিংটনের বার্তা

ইরানের শনিবারের হামলার পর নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইসরায়েলের প্রতি ‘লৌহকঠিন’ মার্কিন সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ জি৭ নেতারা এরই মধ্যে ইরানের নিন্দা করার পাশাপাশি উত্তেজনা প্রশমিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে ইসরায়েলের সুরক্ষায় পাশে থাকার অঙ্গীকার করলেও ইরানে প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলায় সহায়তা করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। বাইডেন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলকে কোনো পাল্টা জবাব দেওয়ার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ওই কর্মকর্তা গত রবিবার সাংবাদিকদের বলেন, বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ‘খুব সতর্কতা এবং কৌশলের সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা করতে’ বলেছেন।

বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া

উত্তেজনা না বাড়ানোর জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো গতকাল সোমবার ইসরায়েলকে সংযত থাকার আহ্বান জানায়। ইরানের মিত্র দেশ রাশিয়া এই হামলা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি। তবে দেশটি গতকাল পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ইসরায়েলকে সংযত থাকার আহ্বানও জানিয়েছে মস্কো। চীনও উত্তেজনা হ্রাসের আহ্বান জানিয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর ইসরায়েলের অনুরোধে স্থানীয় সময় রবিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানান ইসরায়েলের জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত। অন্যদিকে আত্মরক্ষার্থে এ হামলা ‘জরুরি’ ছিল বলে দাবি করেন ইরানের দূত। বৈঠকের শুরুতে দেওয়া ভাষণে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য খাদের দ্বারপ্রান্তে। এ অঞ্চলের মানুষ সত্যিকার অর্থেই একটি পূর্ণ মাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। এখনই সময় এ উত্তেজনা ও সংঘাতের লাগাম টানার। এই অঞ্চল থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বেরই আর কোনো যুদ্ধের ধকল সহ্য করার অবস্থা নেই।’

রাফাহতে অভিযান পিছিয়ে যাবে

এদিকে ইসরায়েলি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার গতকালের বৈঠকে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে পরিকল্পিত স্থল অভিযান ইরানের হামলার কারণে পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকালই বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের রাফাহ থেকে সরে যাওয়ার জন্য শহরের কয়েকটি অংশে ইসরায়েলির বাহিনীর উড়োজাহাজ থেকে প্রচারপত্র ফেলার কথা ছিল। অবশ্য রাফাহতে স্থল অভিযানের ব্যাপারে ইসরায়েল এখনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন