মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ও সহিংসতা বৃদ্ধির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ ও কাতার। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং উদ্বেগ জানান।
বৈঠকে উভয় নেতা ফিলিস্তিন সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য বিশ্বনেতাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁরা ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ, বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
কাতারের আমিরের দুই দিনের সফর শেষে গতকাল বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিগুলো হলো দ্বৈত কর ও কর ফাঁকি পরিহার, আইনি বিষয়ে সহযোগিতা, সমুদ্র পরিবহন, পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা এবং একটি যৌথ ব্যাবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। এর বাইরে শ্রমশক্তি, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতাসহ পাঁচটি এমওইউ সই হয়েছে।
উভয় নেতা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং কাতারের আমিরের নামে ঢাকার ইসিবি চত্বর থেকে কালশী পর্যন্ত একটি সড়ক এবং মিরপুরে একটি পার্কের উদ্বোধন ও নামকরণ প্রত্যক্ষ করেন।
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠন করার পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে এটিই প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় সফর। বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত সোমবার কাতারের আমিরকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এবং কাতারের আমিরের নেতৃত্বে তাঁর দেশের প্রতিনিধিদল গতকাল ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফলপ্রসূ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে। সেখানে উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রশংসা করে। তারা আরো আলোচনা, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং সরকারি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সব স্তরে সফর বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ককে আরো বাড়ানো ও এগিয়ে নেওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জ্বালানি ও শক্তি, জনশক্তি, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা ত্বরান্বিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ও কাতার প্রতিনিধিদলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি উন্নত জ্ঞানভিত্তিক বহু-সাংস্কৃতিক সমাজ হিসেবে কাতারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ও রূপান্তর এবং আমিরের নেতৃত্বে মধ্যস্থতা ও বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে কাতারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার গভীর প্রশংসা করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যও তিনি কাতারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন। একটি উদীয়মান বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন তিনি। কাতার ও বাংলাদেশের মধ্যে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তিনি উভয় পক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
কাতারের আমির বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে ব্যবসা অন্বেষণে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি কাতারের উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। কাতারপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশ ও কাতার—দুই দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখছেন বলে তিনি জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে আরো কর্মী, পেশাজীবী, নার্স, টেকনিশিয়ান, সেবা দানকারী ইত্যাদি নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য কাতার আমিরকে অনুরোধ করেছিলেন। কাতারের আমির এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও কাতারের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠনকে স্বাগত জানান। ব্যাবসায়িক সম্প্রদায়ের যোগাযোগের সুবিধার্থে তাদের ভিসা পদ্ধতি সহজ করতে প্রধানমন্ত্রী কাতারের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী কাতারের বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের কক্সবাজারে পর্যটন খাত উন্নয়ন এবং তাঁদের জন্য নিবেদিত বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ করার প্রস্তাব দেন।
কাতারের আমির অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কক্সবাজারের পর্যটন স্পটগুলোতে বিনিয়োগের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, তিনি কাতার বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ (কিউআইএ) এবং কাতারের ব্যাবসায়িক প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফর করতে এবং প্রস্তাবিত খাতগুলোতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখতে বলবেন।
কাতারের আমির তাঁর দেশে মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পর্কে বৈঠককে অবহিত করেন। তিনি সেখানে সম্ভাব্য বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ করতে কাতারে ব্যাবসায়িক প্রতিনিধিদল পাঠাতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। উভয় নেতা জ্বালানি খাতে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা এ সহযোগিতা আরো এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আমির ও তাঁর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। রাষ্ট্রপতি কাতারে সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের জন্য আমিরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বাংলাদেশ থেকে আরো দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মী নিয়োগের অনুরোধ জানান।
পরে কাতারের আমির একটি আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। কাতারের আমিরের সম্মানে বঙ্গভবনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মধ্যাহ্নভোজে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ছাড়াও গণমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সফর শেষে গতকাল বিকেলে নেপালের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন কাতারের আমির।
আমিরের ঢাকা সফরের প্রথম দিন সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও কাতারের ব্যবসায়ীরা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কাতার বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে আগ্রহী।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে গতকাল বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন