জনতার মঞ্চে ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন একসময়ের মানবিক নায়ক-মিল্টন! আমাদের যে সরল বিশ্বাস ছিল, জনতা যে সম্মান তার প্রতি রেখেছিল তা নিমিষেই ভেঙেচুরে একাকার
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
মিল্টন সমাদ্দার! শৈশবের কত-শত ঘন্টা তার সেবামূলক কার্যক্রমের ভিডিও দেখে কাটেয়েছি। দুনিয়াতে এখনও এমন ভালোমানুষ আছে-ভেবেছি! যারা নিজের খেয়ে গরীব-দুঃখী-দুঃস্থদের সেবা করে, পথের বিপন্নত মানুষদের খুঁজে খুঁজে আশ্রয় দেয় কিংবা পরিবার পরিত্যক্ত বয়স্কদের যত্ন করে লালন করে! এই মানবিক মিল্টন সম্মাদেরকেই এতোদিন চিনতাম! ঠিকানাবিহীন মরদেহের গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা করে রাতারাতি হিরো হয়ে যাওয়া, অন্তত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া মিল্টনের যে আরও একটি চরিত্র আছে, যেটা তার আসল চরিত্র, সেটা কি একটুও আঁচ করতে পেরেছিলাম?
জনতার মঞ্চে ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন একসময়ের মানবিক নায়ক-মিল্টন! আমাদের যে সরল বিশ্বাস ছিল, জনতা যে সম্মান তার প্রতি রেখেছিল তা নিমিষেই ভেঙেচুরে একাকার। তার সেবামূলক কর্মকান্ডে প্রেরণা দিতে এবং চালিয়ে নিতে দানবীর মানুষেরা অকাতরে দান করেছেন! সেই দানের জন্য প্রদেয় কোটি কোটি টাকা তিনি লুটপাট করেছেন! সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ১৩ সদস্যের প্রমোশনাল টিম তৈরি করেছেন। তার কাজের ভিডিও বুষ্ট করে সাধারণ মানুষের সিমপ্যাথী সেক করেছে! জমি দখল, জালিয়াতি, অঙ্গ চুরি কিংবা দাফনকৃত লাশের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা তার নিত্যাকার চরিত্র! নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী পোষা, শারীরিক নির্যাতন, জিম্মি করা-এসব মিল্টন সমাদ্দারের যাপিত জীবনের রুটিন!-সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে! অথচ মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কী নির্ভুল অভিনয়টাই না তিনি করেছেন!
অকাতরে নির্লোভ-নির্মোহ মানবসেবা করার জন্য প্রত্যেকযুগে কিছু প্রচারবিমুখ মানুষ থাকে। যাদের কারণে পৃথিবীতে মানবিকতাবোধ বেঁচে থাকে। অথচ কিছু দুষ্টু মানুষের কর্মকান্ডে সেই মহৎকর্ম প্রশ্নবিদ্ধ হয়! লোকদেখানো মানবসেবার অন্তরালে কত ঘৃণ্য মানসিকতা, ব্যবসায়িক অসততা এবং সরল মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জঘণ্যতা থাকতে পারে তার অনন্য নজির মূর্তমান মিল্টনে! গণমাধ্যম প্রকাশিত সংবাদ যদি আংশিক সত্যও হয় তবে তাকে বাহ্যিকভাবে বিচার করে মানুষ চেনার দৌড়ে আরেকবার ঠকেছি। হাসির আড়ালেও যে এমন দানবীয় চরিত্র লুকিয়ে রাখা যায়, সেবার নামেও যে এমন কপটতা দেখানো যায় সেটা কেউ কেউ দেখিয়েছে! হয়তো মিল্টন সমাদ্দার তাদের একজন! প্রতি মাসে কোটি টাকা ডোনেশন পাওয়া এবং সেটা কোথায়, কীভাবে খরচ হয় সেটা দেখার জন্য রাষ্ট্রীয় পাহারাদার নিশ্চয়ই আছে। মিল্টনের কর্মকান্ডে তারা চোখ রেখেছিল কিনা কে জানে! এখন নিশ্চয়ই নড়েচড়ে উঠবে!
আমি চাই, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ এসেছে তার সবগুলো মিথ্যা হোক! আমরা আসলে বিপন্নবোধ করছি! যারেই বিশ্বাস করি সেখানেই ঠকি কিংবা ধোঁকা খেয়ে আঘাত পাই। যাকে আদর্শ বানাই তার আমলানামা প্রকাশ পেলেই দেখি, সেও রাষ্ট্রের একাংশ গলাধঃকরণ করেছে! যেখানে সুযোগ পেয়েছে সেখান থেকেই খেয়েছে! কত মানুষের ঘাম, শ্রম পোড়ানো পয়সা হাতিয়ে সুরম্য অট্টালিকা করেছে, বর্ডারের ওপারে দেশের অর্থ পাঠিয়েছে! পাড়ায় পাড়ায় তাদের স্মৃতিচিহ্ন পড়েছে! মিল্টনরা সেখানে ছোট্ট ছোট্ট পিলার! কত সহজে সরল মানুষগুলোর বিশ্বাসের ঘরে ডাকাতি করা যায়, আবেগীয় ব্ল্যাকমেইল করা যায়, বিস্তর অন্ধকার আড়ালো রেখে একফোঁটা আলোর ঝলক দেখিয়ে মানুষের পকেটের টাকা মেরে দেওয়া যায়-তার উজ্জ্বল নকশা মিল্টন এঁকেছেন! বাড়াবাড়ি রকমের প্রচারপ্রিয় প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ ভন্ড!-বেদনার অভিজ্ঞতাগুলো অন্তত তাই বলছে!
আমাদের মানবতার ফেরিওয়ালাদের দরকার। একজন ঘরহীন মানুষকে ঘর করে দিতে, খাদ্য-বস্ত্রহীন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে, মানুষের অসীম অভাবের সসীম অংশ পূরণ করতে কিংবা সেবা বঞ্চিত পরিবারহারা মানুষগুলোকে যত্ন করতে পারে কেবল তারাই যাদের মহৎ হৃদয় আছে। বিভিন্ন সংকটে এইসব মানুষগুলো ভরসার ছায়া নিয়ে বিপন্নদের পাশে দাঁড়ায়। কিছু ভালো মানুষের পদচিহ্ন ধুলোবালির পৃথিবীতে আছে বলেই আরও কিছুদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে, এখনো আশার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু! যখন এই মহৎ মানুষগুলোর সাথে কিছু অতি দুষ্টলোক ভালোর ছল ধরে থাকে তবে ভালো-মন্দের সবাই সন্দেহের খাঁচায় বন্দী হয়। মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে, দান করতে অনুৎসাহিত বোধ করতে শুরু করে। কাজেই ভন্ডের মুখোশ যত তাড়াতাড়ি উন্মোচিত হবে ততদ্রুত মানবকল্যাণ পুরোপুরি নিশ্চিত হবে।
মিল্টন সমাদ্দারের গোপন চরিত্র ও চাহিদার বিচার রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন করবে।রাষ্ট্র মুক্তি দিলেও জনসাধারণের ঘৃণার তাপ তার পাপকে শক্ত করে তুলবে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি যেটুকু ছড়িয়েছেন সেটুকুও কম মহত্ত্বের নয়। যেখানে আমি-আপনি কিছুই করতে পারিনি সেখানে তিনি অন্তত অনেককিছু করেছেন। লোক দেখানোর জন্য হলেও করেছেন। যারা কিছু করে না বরং শুধু লোভ করে আর ভোগ করে তাদের থেকে মিল্টন সমাদ্দার অনেকটা ভালো! তার বিরুদ্ধের গণমাধ্যমের সংবাদ যদি সত্য হয় তবে তার শাস্তি হোক। তবে যদি শোধরানোর সুযোগ থাকে তবে শুধরে মানবসেবায় রাখা হোক। অপরের জন্য করা-এই মানসিকতার মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। লোকদেখাতেও কেউ কোন ভালোকাজ করতে চাচ্ছে না! সবাই শুধু সবার ঝোলা ভরতে ব্যস্ত! দেশের খুতি উপচে উঠলেই দেশের টাকা যারা বিদেশে পাচার করে দেয়-তাদের নামে এক পৃথিবী ঘৃণা। ভন্ডরা সাধুর বেশেই থাকে! চিহ্নিত করে শিকড়সহ উপড়ে নিতে হবে! দুষ্ট সাধু হইলেও পরিত্যাজ্য!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন