আমাদের চারপাশের চরিত্র চাওয়াচাওয়িতে আটকে আছে। কখনো কখনো জোর করেও আদায় করতে হয়! ভালোবাসা কিংবা প্রীতি-উপহার,সম্মান
রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
==============================================
এক।
মনের ভাবনা মনে রাখা তথা অন্তর্মুখী মানুষগুলো সুন্দর স্বভাবের হলেও চারপাশ তাদেরকে ঠকিয়ে দেয়! বন্ধুত্ব, পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে যে কিছুই চায়নি অথচ পেয়েছে-সেটা বিরল! বর্তমান রীতিনীতিতে যা কিছু দরকার তা চেয়ে নিতে হয়! চাইলে সরকারও দিয়ে কিংবা না দিয়ে সমাধান দিতে পারে! আমাদের চারপাশের চরিত্র চাওয়াচাওয়িতে আটকে আছে। কখনো কখনো জোর করেও আদায় করতে হয়! ভালোবাসা কিংবা প্রীতি-উপহার, সম্মান কিংবা প্রাপ্য অধিকার না চাইলে আজকাল আর কেউ সেধে দেয় না! পেতে লড়তে হয়! কখনো পা-মাথা ধরতে হয়! মনের চাওয়া বাহিরে না এলে চাওয়া-পাওয়ার সব সমীকরণ মনাঙ্কের সমাধান 'ধরুন কিংবা 'মনে করুন'-এসব ধাপ্পাবাজিতে আটকে থাকে!
অন্তর্মুখী মানুষের একটা বড়সড় রকমের সুবিধাও আছে বটে! সে সুবিধা তাদের যতটুকু তার অধিক তাদের জড়িয়ে থাকা মানুষদের! মনের কথা মনে রাখা মানুষদের শখ-আহ্লাদ, চাহিদা-স্বপ্ন কেউ কোনদিন জানতে পারে না! সে কিসে খুশি হয় আর কিসে দুঃখ পায়-সেসব নিজের মধ্যেই আটকে রাখে! গোমট বুকের ভারে একটা জীবন অকাতরে কাটিয়ে দেয়! যারা তারে দুঃখ দেয়, যারা ব্যথার কারণ হয় তারাও জানতে পারে না যে, তাদের নামে অভিযোগের পাহাড় আছে! চোখের অনেক জলের উৎস-পথে তাদের নাম লেখা আছে!
তবে যাদের বোধ-বিবেক আছে, যারা সবার স্বার্থ সমান চোখে দেখে কিংবা ভালোবাসতে জানে তারা তাদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ভালোবাসায় ভর থেকে হাসতে থাকা মানুষগুলোকে কখনো ঠকায় না। বরং বিভিন্ন উপলক্ষে, নিজস্ব মুহূর্তে হরেক উদযাপনে বিস্মিত করে দেয়। যারা অন্তর্মুখী তারা অভিযোগ-অনুযোগ সেভাবে করে না বটে তবে অবহেলায় গুমরে কাঁদে। একবার যদি তাদের দুঃখের বাঁধ ভাঙে তবে কত তীব্র স্রোতে চারপাশ ভাসিয়ে নিতে পারে, তা যে সয়েছে সে বুঝেছে! যে দেখেছে সে হয়রান হয়েছে!
দুই।
আজকাল বহির্মুখী মানুষের সংখ্যাই বেশি! আমাদেরকে যারা ঘিরে আছে কিংবা যাদের নিয়ে আমরা আছি তাদের অনেকেই মনের মধ্যে যা আছে তার অধিক শুনিয়ে বেড়ায়! তারা জীবনের নামে অভিযোগ শোনায়, ভালোবাসা আদায়ে নামে এবং ঋণের হালখাতা খুলেই রাখে! মিছিল-সংগ্রামে মনরাজ্য মাতিয়ে রাখে! কখনো কখনো অন্যকে তাতিয়ে রাখে! তাদের যার যা প্রাপ্য তার অধিক দখলে রাখে! অন্যদের কে, কী পেল আর কে খেল না তা ভাবার সময় খুব কম মানুষের! নিজেকে জাহির করার, স্বার্থের দুয়ারে হাজির করার প্রস্তুতি-যাত্রা এবং স্লোগান- এভাবেই চলছে! কিছু না করেও ক্রেডিট নেওয়া, ভেতরের চেয়ে বাহিরে বেশি প্রদর্শন করা-এরা এভাবেই সুখী হতে চায়! বাহ্যিকতার নির্লজ্জতা দেখে ভেতর লজ্জা পায়!
চারপাশে এতবেশি বহির্মুখী মানুষের উপস্থিতি যে, কে, কতবেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারছে, অহংকার-দম্ভে কে কাউকে পেছনে ফেলতে পারছে কিংবা কে কতো রঙিন হয়ে সামনে দাপিয়ে আসতে পারছে-মানুষ সেসব দেখেই বিচার করে বেশি! ভেতরে কী আছে, সে নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নাই! ভিউ বাণিজ্যের আলাদা মাত্রা দিয়েছে এই বহির্মুখীতাকে! রুমের বদ্ধ কোন, দেহের শেষ ভাঁজ কিংবা বিবেকের পঁচা আস্তরণ- কিছুই আর গোপন কিংবা পিছিয়ে থাকছে না! যার নাই তাকে আঘাত করে, যে দুর্বল তাকে দেখিয়ে দিয়ে মানসিক তৃপ্তির রসদ খুঁজছে! সবাই-অনেকেই!
এই বহির্মুখীতায় জ্ঞানের প্রতিপক্ষ করা হয়েছে অর্থকে, সম্মান আদায় করা হচ্ছে শাসিয়ে এবং মানুষের বিচার হচ্ছে পোশাকে! এই যে স্বভাবে খাই খাই, ন্যাচারে আরও চাই আরও চাই- এসব ভালো না। নিজেকে ততটুকু প্রকাশ করলেই হয় যতটুকু প্রয়োজন এবং সেটুকুতেও বিনয় থাকতে হয়। নিজের স্বার্থের চেয়ে পরার্থকে বেশি প্রাধান্য দিলে তবেই সমতা রক্ষা পায়। নিজের কথা বলতে গিয়ে অন্যের স্বর যাতে চাপা না পরে, সব নিজের কোলে টানতে গিয়ে কারো অধিকার যেন অরক্ষিত না থাকে! সামগ্রিক কল্যাণের জন্য আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে যেতে হয়! ধীরে ধীরে মিলেমিশে নিন্দনীয় স্বভাব তাড়িয়ে দিলেই হয়!
তিন।
অন্তর্মুখী কিংবা বহুর্মুখিতা এর কোনটা ভালো? দুটোই ভালো আবার দুটোই খরাপ! নিজেকে বঞ্চিত করার যেমন সুযোগ নাই তেমনি অন্যকেও ঠকানো ঠিক নয়। জীবনের নামে কৃতজ্ঞতা ও অভিযোগ দুটোই পরিমিত পর্যায়ে থাকুক। কৃতজ্ঞতা না থাকলে সুখী হওয়া যাবে না আবার কিছু অভিযোগ না থাকলেও স্বপ্ন গড়ে উঠবে না। জীবন যদি দুই তীরে ব্যালেন্স করে বাড়ে তবে সুখ-দুঃখের নদীতে চর জাগে না বরং চিরকাল জোয়ার-ভাটার লড়াই দারুণভাবে জমে। এই এক জীবনে খুনসুটি আর দায়িত্ববোধের, ভালোবাসা আর সম্মানের যাত্রা মসৃণতায় জীবনটাকে ঘুরিয়ে দেখাক। কাউকে বঞ্চিত করে, কাউকে পেছনে ঠেলে খুব বেশি সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না! অনেক কিছু হাসিল করে, কারো পাওনা না মিটিয়ে কে সুখী হতে পেরেছে? আড়ালের অভিশাপে আগামী তছনছ করে দিতে পারে! কখনো চেয়ে নিয়ে আবার কখনো মিটিয়ে দিয়ে-আমাদের জীবন ফুল-মুকুলে ভরে উঠুক!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন