সব গাছ কাইটা ফালাইতাসে। আমি ঔষধ বানামু কি দিয়া? কিগো কবিরাজ, কি খোঁজতাসেন?
---------------------------------------
রাজূ আহমেদ। কলাম লেখক।
।।এক।।
পৃথিবীতে যতগুলো ভালোকাজ টিকে আছে সেগুলোর মধ্যে বৃক্ষরোপণ অন্যতম একটি। শুধু মানুষ নয় বরং সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ ও নিঃসরণের যে চক্র তা নিয়ন্ত্রণ করে গাছপালা, বৃক্ষ-তরুলতা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশ-প্রকৃতিকে রক্ষা করতে বৃক্ষ প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই যে তীব্র গরমে নাভিশ্বাস অবস্থা, সূর্যের তাপে মানুষ পুড়ছে-এর পেছনেও বৃক্ষ সংকটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৃক্ষরোপণ একটি জীবন্ত সাদকাহ। এ সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে। আর তা থেকে কোনো পোকামাকড় কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০; মুসলিম, হাদিস : ৪০৫৫)
ইসলাম ধর্ম বৃক্ষরোপণকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং গুরুত্বসহকারে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে আর ফলদার হওয়া নাগাদ তার দেখাশোনা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সদকার সওয়াব দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৭০২; শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩২২৩)। ধর্মে বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে কেবল নির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং বিনাপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। পরিবেশ শান্ত, শীতল ও মনোমুগ্ধকর রাখতে গাছের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন প্রিয়নবী (সা.)। আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৪১)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে [যে গাছ মানুষের উপকার করতো], আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (বায়হাকি, হাদিস: ৬/১৪০)
বৃক্ষ থেকে ফুল-ফল, ছায়া কিংব জ্বালানী এসব উপকারের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু জীবজগতের অস্তিত্ব টিকে থাকে যে বৃক্ষের দ্বারা সেগুলোর ঋণ কী করে ভুলি? মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইড চক্রের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ প্রতিদিন ১১ হাজার লিটার বাতাস নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, যা সে বৃক্ষ থেকে বিনামূল্যেই পেয়ে থাকে। বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন ৫৫০ লিটার খাঁটি অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। যদি এই সমপরিমাণ অক্সিজেন টাকা দিয়ে কিনতে হতো তবে প্রতিদিন ১৮ লাখ টাকা খরচ করতে হতো! উল্লেখ্য, কোনো ধরনের খাবার ছাড়া বেঁচে থাকা যায় অন্তত ২১ দিন; পানি ছাড়া ৩ দিন আর বাতাস ছাড়া বেঁচে থাকা যায় মাত্র ৩ মিনিট। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। গাছপালা ও বৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। চারদিক সজীব-সতেজ ও স্বাভাবিক রাখে।
।। দুই।।
সারাদেশের মানুষ তীব্র গরমে যেভাবে কষ্ট পাচ্ছে তা অসহনীয় ও অবর্ণনীয়! ২৬ এপ্রিল-২০২৪ চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়, যা চলতি বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানিয়েছে জেলা আবহাওয়া অফিস। এমনকি গত ৭৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি! থার্মোমিটারে তাপমাত্রায় ৪২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও অনুভূত তাপমাত্রাা ৪৫ এর মত। সবকিছু পুড়িয়ে যাচ্ছে। হিট ওয়েভে উৎপাদন ব্যবস্থায় ধ্বংস নেমেছে, কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, খামারির মুরগি মারা যাচ্ছে, মাছ কাতরাচ্ছে এবং ফসল পুড়ে যাচ্ছে। কাজেই বৃক্ষরোপণ আন্দোলন ত্বরান্বিত করতেই হবে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণের ঘোষণা দিয়েছেন এবং কেউ কেউ কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আজকের লেখার মূল আপত্তিটা আসলে এখানেই! বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে আপত্তি নয় বরং বৃক্ষরোপণের সময় ও উপযুক্ততা নিয়ে বিতর্ক। যে উদ্দেশ্য এই সময়ে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে তা কি কাজের কাজে মোটেই আসবে?
আজ যে বৃক্ষটি লাগানো হবে সেটার সুফল পুরোপুরিভাবে আজকেই পাবো না। কয়েকবছর সময় লাগবে। কাজেই আরেকটু সময় নিয়ে উপযুক্ত সময়ে অপেক্ষায় থাকা বোধহয় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিবেচনায় জুন, জুলাই ও আগস্ট হচ্ছে গাছের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। কেননা যে স্থানে বৃক্ষরোপণ করা হবে সে স্থানের পারিপার্শ্বিকতা সাথে খাপ খাইয়ে বৃক্ষের বেড়ে ওঠার উপযুক্ত আবহাওয়া থাকতে হবে। বর্তমানে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে। অত্যাধিক সূর্যের আলো মাটির জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি বৃক্ষ-শিশুর জন্যও ক্ষতিকর। কাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হুজুগে খুন্তি-চারা নিয়ে এখনই চারা রোপন ঠিক কাজ হবে না। প্রকৃতির রুক্ষতায় চারা সমূলে শুকিয়ে যাবে। তাও এই সময়ে চারা রোপন করে সেটাকে টিকিয়ে রাখা যেতো যদি নিয়মিত পানি দেওয়া হতো। এই বৃহত্তর বৃক্ষরোপণের আন্দোলনে কে এতো গাছের গোড়ায় পানি দেবে? কাজেই পানির জন্য বৃষ্টির অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই আরেকটু অপেক্ষা করি। প্রকৃতিকে আষাঢ় আসুক। তখন মাটি ও পরিবেশ জীবনের অনুকূলে থাকে।
যে চারাগুলো এখন নার্সারি থেকে তুলে আনা হচ্ছে সেগুলো সেখান থেকে অক্সিজেন ছড়াচ্ছিল এবং পরিবেশ শীতল রাখতে ভূমিকা রাখছিল। বরং এই প্রতিকূল সময় সেগুলো নতুন মাটিতে দিলে মূলে প্রয়োজনীয় তোষ পাবে না এবং তীব্র তাপে মাটির ওপরের অংশ শুকিয়ে যাবে। কাজেই এই সময়ে বৃক্ষরোপণের আন্দোলন হিতে-বিপরীত ঘটাবে। চারা সংরক্ষণে শুধু তাপ নয় বরং আরও কিছু কাজ আছে, যা বর্তমান বৃক্ষরোপণ আন্দোলনে অনুপস্থিত! চারা রোপনের পর সেটিকে টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ। এজন্য গরু, ছাগল ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণী থেকে চারাকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সঠিক নিয়মে বৃক্ষরোপণ ও যত্ন নিতে হবে। উপযুক্ত মৌসুমে গাছের চারা রোপণের পাশাপাশি তাদের অনবরত পরিচর্যাও জরুরি। তা না হলে গাছের চারা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। চারা রোপনের জন্য ছাদবাগান হতে পারে সর্বাধিক পছন্দনীয় আঙিনা। কেননা এটা অল্পতেই গুছিয়ে রাখা সম্ভব, সেখানে সহজে পানি দেওয়া যায় এবং সংরক্ষণ করা যায়।
।।তিন।।
শৈশবের সেই বিজ্ঞাপন, প্রিয় আবুল খায়ের এর এই বিজ্ঞাপনের কথা কারো মনে আছে?
— সব গাছ কাইটা ফালাইতাসে। আমি ঔষধ বানামু কি দিয়া?
কিগো কবিরাজ, কি খোঁজতাসেন?
-- আইচ্চা, এইখানে একটা অর্জুন গাছ আছিলো না?
আছিলো, কাইট্টা ফালাইছে।
-- এইখানে একটা শিশু গাছ আর ঐ মাথায় একটা হরতকী গাছ?
আছিলো, কাইট্টা ফালাইছি।
-- আপনের গাছ?
হ, টেকার দরকার পড়ছে তাই বিক্রি করছি।
গাছ লাগাইছিলো কে?
-- আমার বাবায়।
আপনি কী লাগাইছেন?
-- আমি কী লাগাইছি?
* হ, ভবিষ্যতে আপনার পোলারও টেকার দরকার হইতে পারে.........
আবুল খায়েরের শেষ কথাটি ছিল: "এক একটা গাছ, এক একটা অক্সিজেনের ফ্যাক্টরী।"
প্রয়োজনে গাছ কেটে তার বদলে অন্তত তিনটি গাছ না লাগালে কিংবা বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করলে এমন গরমের বছর, ভয়ংকর সাইক্লোনের বছর কিংবা তীব্র খরার বছর আমরা প্রত্যেকবছরই পাবো! যা প্রত্যেকবার তার পূর্বেরবারের রেকর্ড ভাঙবে। কাঠের ফার্নিচারের বিকল্প ফার্নিচারে অভ্যস্ত হতে হবে। বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বোঝাতে প্রিয় নবী ইরশাদ করেছেন, 'কিয়ামত এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারও হাতে যদি ছোট একটি খেজুরের চারা থাকে, তাহলে সে যেন চারাটি রোপণ করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১২৯০২ ও ১২৯৮১; আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদে বাজজার: ৭৪০৮)। যত দিন পর্যন্ত রোপণকৃত গাছটি জীবিত থাকবে ঠিক তত দিন যত প্রাণী, পশুপাখি ও মানুষ সে গাছ থেকে ফুল, ফল ও ছায়া অর্থাৎ যেকোনো উপকার পাবে, তা রোপণকারীর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়া হিসেবে লেখা হবে। রোপণকারী ব্যক্তি যদি মারাও যান তাহলে তাঁর আমলনামায় এ সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে। যদি না জানিয়ে গাছ থেকে কোনো ফল খায় বা নিয়ে যায় তাতেও রোপণকারীর আমলনামায় সওয়াব পৌঁছে যাবে।
এ বছরের জুন, জুলাই ও আগস্টে আমরা প্রত্যেকে যেন অন্তত তিনটি করে গাছ লাগাই। আমাদের ধরণী শীতল হোক। স্বাভাবিকভাবে বাঁচার স্বপ্ন যেন রোজ দেখতে পারি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন