শ্রমিকদের স্বার্থ তখনই পূর্ণভাবে রক্ষাপাবে যখন দেশ সম্পূর্ণভাবে দুর্ণীতিমুক্ত হবে ।
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক। |
যখন শ্রমিকের কথা ভাবতে বসেছি তখন জীবিকার তাগিদে তীব্র তাপপ্রবাহের মাঝেও লাখ লাখ শ্রমিকের ঘর্মান্ত-ক্লান্ত মুখচ্ছবির চিত্র ভাবনার পুরোটা দখলে নিয়েছে । একে একে ভাবনায় জুড়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের সীমাহীন দুর্ভোগ চিত্র, তৈরি পোশাক শিল্পের কোটি শ্রমিককে সল্প বেতনে জিম্মি করে স্বার্থ আদায়ের উৎসব, গ্রাম বাংলার রোদ-বৃষ্টিতে পোড়া-ভেজা কৃষককূলের শ্রমকে অবমূল্যায়ন করে তাদেরকে মানুষসম মর্যাদা না দেয়ার ঘৃণ্য মানসিকতা । দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দূর্ভোগ ও দমনের চিত্রও সমভাবে ভাবিত করছে । বছরের মে দিবসে আমরা সবাই মিলে একবার শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াই অথচ বাকি দিনগুলোতে ভুলে যাই ওরাও মানুষ, আমাদের জ্ঞাতি । পেষণের স্টিম রোলার চালাতে চালাতে সবলের স্বার্থের সবটুকু উদ্ধার করা হয় দুর্বলের রক্ত শুষে ।
শ্রমিকের শ্রম মানব সভ্যতার জনক । দেশের সম্মৃদ্ধির সবটুকুই শ্রমিকের শ্রমে তিলে তিলে গড়ে ওঠা । ব্যাংকের রিজার্ভ কিংবা সামগ্রিক উন্নয়নের সবটুকু জুড়ে কেবল শ্রমিকশ্রেণীর একক আধিপত্য অথচ মূল্যায়ণের বেলায় শ্রমিকদের শ্রম ও ত্যাগকে বিবেচনাতেই আনা হয়না । যে প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত পানি করে আয় করে পাঠানো রেমিট্যান্সে ব্যাংকের রিজার্ভ স্থির আছে সেই শ্রমিকদেরকে বিমানবন্দরে নানাভাবে হেনস্তা করা হয় অথচ ভিআইপির মর্যাদা পায় এদেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী কিংবা লুটেরাদের একাংশে । প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে তাদের সমস্যাগুলো শোনার কর্তৃপক্ষও মাঝে মাঝে মেলে না । যে শ্রমিকদের আয়ের টাকায় দেশের অর্থখাত সচল আছে তাদের বিবেচিত হওয়া উচিত ছিল প্রকৃত ভিআইপি এবং এদেশের গর্ব অথচ শ্রমিক বলে অভিজাতদের গন্ডিতে ওদের প্রবেশ নিষেধ ।
যদিও বাংলাদেশ মিশ্র-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নির্ভরশীল তবুও আজও দেশের মানুষের আহারের সিংহভাগ জোটে কৃষকের ত্যাগে । আলো ফোঁটার আগে ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে যে কৃষকরা মাঠে যান এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে কোটি মানুষের আহারের উৎপাদন করেন, সেই তাদের মূল্যায়ণ এই সমাজে কতটুকু ? মধ্যসত্বভোগীদের কূটচাল এবং দুর্নীতিগ্রস্থদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কৃষকরা আজ সমাজের সবচেয়ে উপেক্ষিত জীব । মৌল মানবিক অধিকারের অনেকগুলো তাদের ভাগ্যে জোটে না । দেশবাসীর খাদ্য উৎপাদনের কারিগর হলেও তাদের এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল স্বজনদের অর্ধক্ষুধা পেটেই থেকে যায় । শিক্ষা এবং চিকিৎসা প্রাপ্তিতেও তাদের সন্তোষজনক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি । দেশের অন্যান্য শ্রমিকদের ভাগ্যেও জোটেনি সন্তোষজনক জীবনাচার । শ্রমিকদের ব্যবহার করে ধণিক শ্রেণীরা রাতারাতি বণিক শ্রেণীতে উপনীত হচ্ছে অথচ শ্রমিকদের ভাগ্য বদলে কোন পরিবর্তন ধরা পড়েনা বিবেকসম্মত মানসচক্ষুর আয়নায় ।
বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থার চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তৈরি পোশাক শিল্পকে । বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাকখাত দেশের অন্যতম ভরসা । অথচ কতটা মানবেতরা জীবনযাপন করে এই খাতের শ্রমিকরা তা বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া উপলব্ধি করা কিছুটা মুশকিল । শহরের বাসা ভাড়া, খাবার, বস্ত্র ও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে তাদের সর্বনিম্ন ৮২০০ টাকা মাসিক বেতনের সম্বল কতটুকু যৌক্তিক তা আবারও বিবেচনায় আনা উচিত । পরিবারের যে সদস্যরা চাকরি করে তাদের দিকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মুখিয়ে থাকে । কাজেই শ্রমিক যদি না বাঁচে, তবে দেশ বাঁচানো মুশকিল হবে । দেশের অর্থনীতির লাইফ 'ব্লাড তথা' তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের যথাযথ বেতন ও মানসম্মত জীবনাচার নিশ্চিত করা না গেলে, সেটা দেশের স্বাপ্নিক উন্নয়নের গতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া রাখবে ।
অবশ্যই স্বীকার্য যে, বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ণ করেছে । তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, শ্রমিকদের ভাগ্য সে অর্থে বদলায়নি । পরিবর্তন আসেনি তাদের হৃষ্ট-ক্লিষ্ট চেহারায় । কেননা শোষনের যাঁতাকলে প্রত্যহ তারা পিষ্ট হচ্ছে । খন্দকার মোঃ ইলিয়াস যথার্থ বলেছেন, ‘ধণিক ও তাদের অনুচরেরা আজ আস্ত মানুষ চুরি করে বিক্রি করে না, আজ তারা কেনা-বেচা করে শ্রমিকের শ্রম, চুরি করে শ্রমিকের মেহনত ।’ আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে সহজেই ধরা পরে মালিক-শ্রমিক কিংবা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে প্রকট বৈষম্যের চিত্র । বৈষম্যের এ ধারা অব্যাহত থাকলে যে কোন ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে সমাজকে । কেননা শ্রমিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে এবং সে চেষ্টা বিপ্লবরূপেও আবির্ভূত হতে পারে । অতীতে বারবার পরিবহন ধর্মঘটে লক্ষনীয় হয়েছে, সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়া তাদের জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয় । কাজেই শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক ।
শ্রমিকদের স্বার্থ তখনই পূর্ণভাবে রক্ষাপাবে যখন দেশ সম্পূর্ণভাবে দুর্ণীতিমুক্ত হবে । একথা সবাই স্বীকার করবে যে, কোন শ্রমিক কোনভাবেই দুর্নীতি করে না কিংবা দুর্নীতির সাথে যুক্ত হওয়ার সাধ্যও তাদের নাই । কাজেই যারা দুর্নীতির সাথে যুক্ত তাদের প্রত্যেকেই সমাজের উপরের শ্রেনী কিংবা ভদ্রতার মুখোশে ক্ষমতাধর লোক । রাষ্ট্রকে স্ব-উদ্যোগে দুর্নীতিবাজদের দমন করে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে । কেননা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত না হলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন এবং সামগ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের জন্য কঠিন হবে । সাম্যের কবি নজরূলের ভাষায়, ‘তুমি শুয়ে র’বে তেতালার ’পরে, আমরা রহিব নিচে/অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে !’-মালিক শ্রেণী যতদ্রুত এ সত্যের নিহিতার্থ উপলব্ধি করতে পারবে ততদ্রুত মঙ্গল হবে সকল পক্ষের । যে সমাজে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অনুপস্থিত থাকে সে সমাজ পরিকল্পিত উন্নয়ন ও কাঙ্খিত গন্তব্যের নাগাল পায়না । কাজেই যারা শ্রমিকদের শ্রম চুরি করে তারা যদি সেপথ পরিহার না করে তবে শ্রমিকের উত্থানেই তাদের পতন নিশ্চিত হবে । কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত ‘The Dascapital’ গ্রন্থে শ্রেণী-সংগ্রামের ব্যাপারে এমন ইঙ্গিতই দিয়ে গেছেন । কাজেই সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে শ্রমিককে তার শ্রমের যথাযথ মূল্য এবং মানুষ হিসেবে তাদেরকে অগ্রগণ্য শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া আবশ্যক ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন