ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ছোটবেলার বন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনের ষড়যন্ত্রে ভারতের কলকাতার একটি বাড়িতে তাঁকে হত্যা করা হয়। গতকাল বুধবার এমন তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা।
ডিবি সূত্র জানায়, পাঁচ কোটি টাকার চুক্তিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ভাড়াটে খুনিদের এমপি আজীমকে হত্যার দায়িত্ব দেন।
যার মূলে রয়েছেন আমান উল্লাহ আমান নামের এক সন্ত্রাসী।
ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন আমান উল্লাহ, জিহাদ ও সিয়াম। গত মঙ্গলবার ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ থেকে প্রথমে তাঁদের আটক করে ডিবি।
এ ঘটনায় গতকাল শেরেবাংলানগর থানায় করা হত্যা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলার বাদী এমপি আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
গ্রেপ্তার তিনজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে ডিবি সূত্র জানায়, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এমপি আজীমের ছোটবেলার বন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডে ছয়জনের বেশি জড়িত।
তাঁদের বেশির ভাগ বাংলাদেশি নাগরিক। ঠিকাদারি ব্যবসা, সীমান্তকেন্দ্রিক সোনা চোরাকারবার নিয়ে বিরোধসহ আরো কয়েকটি কারণে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়।
ডিবি সূত্রের তথ্য মতে, আখতারুজ্জামানের সঙ্গে এমপি আজীমের কোটি কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। এই বিরোধের জের ধরে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি এমপি আজীমকে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করান। তাঁরা একটি নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠনের সদস্য।
আখতারুজ্জামান এর মধ্যে নেপাল হয়ে দুবাই পালিয়ে গেছেন।
হত্যার ষড়যন্ত্র যেভাবে বাস্তবায়ন
ডিবি সূত্র জানায়, এমপি আজীমকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে পাঁচ কোটি টাকার চুক্তিতে দক্ষিণাঞ্চলের চরমপন্থী নেতা আমান উল্লাহকে দায়িত্ব দেন আখতারুজ্জামান শাহীন। সে অনুযায়ী আখতারুজ্জামান আমান উল্লাহকে নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল বিমানে ভারতে যান। কলকাতায় এক বান্ধবীর বাসায় এমপি আজীম হত্যার ষড়যন্ত্র করেন তিনি। ১২ মে চিকিৎসার জন্য দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আজীম। পরদিন ১৩ মে একই বাসায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমান উল্লাহ ও তাঁর সহযোগীরা আজীমকে হত্যা করেন। ১৫ মে আমান উল্লাহ বিমানে দেশে ফিরে আসেন। এরপর তাঁর চার সহযোগী সীমান্তপথে দেশে ফিরে আসেন।
ডিবি জানায়, এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থী নেতা আমান উল্লাহ ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ২০ বছর জেল খেটে জামিনে ছিলেন। তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাঁর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও নানান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাঁদের এমপি আজীমকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে গত ১০ মে ভারত থেকে দেশে ফেরেন আখতারুজ্জামান।
হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন ছয় সন্ত্রাসী
এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন চরমপন্থী নেতা আমান উল্লাহসহ ছয়জন। অন্যরা হলেন আমান উল্লাহর সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল শাহজি, মো. জিহাদ, মো. সিয়াম ও আরেকজন (নাম জানা যায়নি)। তাঁদের মধ্যে আমান উল্লাহ, জিহাদ ও সিয়ামকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। গত মঙ্গলবার ডিবির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপনের নেতৃত্বে ডিবির একটি দল আমান উল্লাহকে প্রথমে গ্রেপ্তার করে। পরে অন্য দুজনকে ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আজীম হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। তাঁরা সম্প্রতি কলকাতা থেকে ফিরেছেন। এর মধ্যে একজনের নাম আমান উল্লাহ আমান। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডের তথ্য দেন। পরে সেই তথ্য দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে। এরপর গতকাল তাঁর মরদেহের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে ভারতের পুলিশ।
পুলিশ জানায়, এমপির সম্পূর্ণ মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আজীমকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে চারটি ট্রলি ব্যাগে মরদেহের টুকরা এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ বর্তমানে সেই ব্যাগগুলোর সন্ধান করছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ভারতের পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, তিনি যে (এমপি আজীম) খুন হয়েছেন, এটি নিশ্চিত। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে। কলকাতার একটি বাসায় পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র যা জানায়
এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, গত ৯ মে ঢাকার বাসা থেকে তাঁর বাবা ঝিনাইদহের উদ্দেশে রওনা হন। ১১ মে বিকেলে বাবার সঙ্গে আলাপে তাঁর বক্তব্য অসংলগ্ন বলে মনে হয়। ১৩ মে বাবার ভারতীয় সিম নাম্বার থেকে উজির মামা বলে পরিচিত একজনের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে মেসেজ আসে, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি। আমার সাথে ভিআইপি আছে। আমি অমিত শাহর সঙ্গে আছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই।’
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ধীরে ধীরে আজীমের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আজীম।
যা বলছেন দলীয় নেতাকর্মীরা
এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক ও ১ নম্বর সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বলেন, ‘কেন কী কারণে খুন করা হলো, এ ব্যাপারে তদন্ত দরকার। যদি দলের লোক জড়িত থাকে বা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব জড়িত থাকে অথবা এই দেশের কোনো লোক জড়িত থাকে, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে চাই। আমরা এই খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঝিনাইদহ সংবাদদাতা ও কালীগঞ্জ প্রতিনিধি)
এমপি আনারের মৃত্যুর খবরে তাঁর কালীগঞ্জের বাড়িতে ছুটে আসেন স্বজনরা। তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন ইউএনও ইসরাত জাহান।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন