সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে বলার সততা ও সাহস না থাকলে তারা প্রয়োজন ফুরোলেই হারিয়ে যায়.........
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক। |
সত্যকে কীভাবে জানেন? যদি তা সরাসরি আপনার কাছে ধরা দেয় এবং সেটাই প্রকাশ-প্রচার করেন তবে সেখানে বিভ্রান্তির সুযোগ কম। তবে সে সত্য যদি অন্য কারো ক্যামেরায় দেখেন, কারো কাছ থেকে শোনেন কিংবা অন্য কোন মতাদর্শীর কাছ থেকে বর্ণনা করেন তখন আপনিও যেভাবে বিভ্রান্ত হবেন তেমনি সেটা প্রচার করলে যারা যারা শুনবে ও মানবে তারাও বিপদগ্রস্ত হবে। একেক মানুষের কাছে সত্যের সংজ্ঞা একেক রকম! কেউ স্বার্থের ঘোর টোপে, কেউ আদর্শের মারপ্যাচে আবার কেউ অভিজ্ঞতার অগভীরতায় সত্যের অংশবিশেষ দেখে। কেউ কেউ সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেল করে একটা অম্লমধুর পরিস্থিতি তৈরি করে আকর্ষণ ধরে রাখতে চায়!
উদাহরণে যেকোনো একটি নির্বাচনের কথা কল্পনা করুন! প্রত্যেক প্রার্থী, সব পক্ষের ভোটার নিশ্চিত থাকে তিনি এবং তাদের মহাজনই জিতবে! নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতা অনুমান করা গেলেও সত্যের শঙ্কা থেকেই যায়! কেননা জনতার একটা ভোট- তাদের কাছে যারাই যায় তাদেরকেই দিয়ে দেয়! দেখা গেলো ভোটের দিন সেই ভোটার ভোটকেন্দ্রের আশেপাশেই নাই! মানুষ যে মত ও মতবাদ বিশ্বাস করে সর্বদা সেটাকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। কেউ যখন কোন বাহনকে ভরসা করে পরিস্থিতির বিচার করতে যায় তখন সে সেই বাহনের আদর্শ ও বিশ্বাস দ্বারাই প্রলুব্ধ হয়ে পরিস্থিতি মূল্যায়ণের চেষ্টা করে। কারো সংস্পর্শে বেশিক্ষণ বা বেশিদিন থাকলে সেই মানুষের কতিপয় স্বভাব অজান্তেই নিজের মধ্যে ট্রান্সমিটেড হয়। কাজেই অসত্য ও অসততার থেকে দূরত্বে থাকাই শ্রেয়! আবর্জনার সাথে সময় কাটাতে বাধ্য হলেও চোখ, নাক ও মস্তিষ্কের ফাঁকফোকর ভালোভাবে বন্ধ করেই সেখানের সোহবতে থাকতে হবে।
মানুষ যে পরিবারে বেড়ে ওঠে, যে পরিস্থিতিতে শিক্ষাগ্রহণ বা অভিজ্ঞতা করে সেখানে প্রভাব দ্বারাই তার স্বভাব গঠিত হয়। মানসিক কাঠামোর গঠন দ্বারাই সে বড় মানুষ নাকি ক্ষুদ্র মানুষ, আলোকিত মানুষ নাকি আলোহীন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে তার নিশ্চায়ন হয়। মানুষ খুব কম ক্ষেত্রে প্রচলিত মত ও আদর্শের বাইরে গিয়ে সত্য আবিষ্কার করতে পারে। কাজেই সে যা যা বিশ্বাস করে সেই ফোরামের অনুরূপ মানুষের সাথে মেশে, তেমন কিতাবাদি দিয়ে এবং পন্ডিতের সাহচর্য নিয়ে জ্ঞান ও শিক্ষা অর্জন করে। কেউ সহজে তার মধ্যের বদ্ধমূল বিশ্বাসে আঘাত করতে চায় না। বাহির থেকে সত্য ও যুক্তির ঢেউ এসে আলোড়িত করুক- সেটাও মেনে নেয় না। সে যা বোঝে এবং যা খোঁজে- তাদের বিশ্বাসে সেটাই চূড়ান্ত সত্য। এর বাইরেও মহাসত্য থাকতে পারে, আরও বড় কল্যাণ আছে এবং কূপমন্ডুকতার থেকে উত্তরণের পথ থাকে। তবুও মানুষ পুরোনো পথেই চলে, অতীতে ধ্যান-ধারনাই পোষে। সে যুক্তির দ্বারা মুক্তি পেতে চায় না।
নিজেকেই সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করতে হবে। কেউ কোন পক্ষের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতেই পারে তবে তাকেও বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের ভাবনা ও বিচার রাখতে হবে। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে বলার সততা ও সাহস না থাকলে তারা প্রয়োজন ফুরোলেই হারিয়ে যায়। যারা টিকে থাকে, যারা সমাজ ও সভ্যতাকে নেতৃত্ব দেয় এবং যারা মহৎ চিন্তায় সময়কে এগিয়ে নেয় তারা বহুমাত্রিকতায় ঘটনা ও পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে। তারা স্বার্থান্ধতা ও চিন্তার বন্ধ্যাত্বের উর্ধ্বে উঠে সত্য ও কল্যাণকে আলিঙ্গন করতে পারে। কারো লেখা পড়ে কিংবা কারো কথা শুনে কোন বিষয়ের ব্যাপারের চূড়ান্ত মন্তব্য করা ঠিক নয়। কেননা লেখক ও বক্তার কোন নিজস্ব অন্ধ দর্শন প্রচার ও বিশাল এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশীদার হয়ে ইজারা নেয়া থাকতে পারে! সত্য নিজেকেই খুঁজতে হবে। কখনো কখনো আবার সত্য নিজে এসেই ধরা দেবে এবং প্রতিভাত হবে। যা দেখি এবং যা দেখি না তার মধ্যে দেখার অংশই সত্যের অধিক নিকটবর্তী। পত্রিকা থেকে জানার কিংবা টেলিভিশন থেকে দেখা ও শোনার মধ্যেও ভূত থাকতে পারে! মানুষ তার স্বার্থ ও বিশ্বাসের উর্ধ্বে উঠে সত্যকে আলিঙ্গন করতে চায় না। অনেকেই কোন না কোন মতাদর্শের মুখপাত্র!
স্যোসাল মিডিয়ার গুজব, ভালোমানুষ সেজে প্রতারণা এবং মানবিকতা দেখানোর নামে সবকিছু লুটেপুটে নেওয়া- সাবধানতা অবলম্বন না করলে ক্ষতির হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। নিত্যদিন কতশত ভন্ডামি ও প্রলোভনের মুখোমুখি হতে হয়- যদি বুদ্ধিশুদ্ধি অকেজো হয় এবং যুক্তির শাখা ধারালো না হয় তবে মনভঙ্গের বেদনা কমানো যাবে না। নিজেকেই একটু অনিসন্ধিৎসু হয়ে সত্য উম্মোচনে ও রহস্য উদঘাটনে তৎপর হতে হবে। তাদের থেকেই কেবল সত্যের সংবাদ গ্রহন ও প্রচার করা যাবে যারা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে। কোথাও কিছু পেলাম আর প্রচার করলাম, লোকমুখে জানলাম আর বলে বেড়ালাম- এর দ্বারা বৃহত্তর পরিসরের ক্ষতি হতে পারে। কারো ফন্দিতে বন্দী না হয়ে বিবেকবোধের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে হবে। যুক্তির পথে মুক্তি খুঁজলে মানবীয় উত্তরণের যাত্রা সহজ হবে। কারো কথা ও বিশ্বাসকে আপ্তবাক্যের মর্যাদা দিলে কোথাও না কোথাও বড়সড় হোঁচট খেতে হতে পারে! সত্য জানার পরে মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যেতে পারে। কাজেই নিজের কল্যাণের স্বার্থেই সত্যকে জানতে হবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন