ভারতে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এসেছিলেন। প্রতিবেশী অন্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরাও এসেছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসার যে তাৎপর্য, সেটি অন্য কারো ক্ষেত্রে লক্ষণীয় নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে শুধু মধুর সম্পর্ক বলে নয়, পারস্পরিক বোঝাপড়া, নির্ভরশীলতা অন্য রকম। আফগানিস্তান আর পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথা হয় এবং পূর্বনির্ধারিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য শেখ হাসিনা আবার ভারতে আসছেন। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে শেখ হাসিনার আবার ভারতে আগমন, কোনো সন্দেহ নেই বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা।
এরপর ৯ থেকে ১২ জুলাই শেখ হাসিনা যাবেন চীনে। চীনও কিন্তু দ্রুত বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য স্থাপনের জন্য তৎপর। ভারত-চীনের সম্পর্ক আমাদের সবার কাছে সুবিদিত। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিতে নির্ভরশীলতা থাকলেও ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের কূটনৈতিক অগ্রাধিকার কখনো ভোলেনি, গুরুত্বও কখনো কমায়নি।
শেখ মুজিব যেমনটা চেয়েছিলেন, অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ যেন বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে না দেখে। আক্রমণকারী ভাবমূর্তি বাংলাদেশ চায় না। অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র, প্রত্যেকের সঙ্গে বাংলাদেশ সুসম্পর্ক নিয়ে এগোতে চায়। সেখানে ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে ১৯৭১ সালের সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে, এমনকি তার আগে থেকেও সে সম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য রকম। তাই এবার অনেক দিন পর যখন আবার ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, কংগ্রেস তুলনামূলক অনেক ভালো ফল করেছে, বিরোধী শিবিরে থাকলেও আসনসংখ্যা বাড়ানোর ফলে এবং বিজেপির আসনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে বিরোধী শিবিরও ভারতে তৎপর হয়েছে।
আর সেই সময় যে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার পারিবারিকভাবে, তাঁর বাবার সময় থেকে সম্পর্ক, সেটা যেন আবার জীবিত হয়ে উঠল এবারের দিল্লি সফরে। যখন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দেখা করতে চলে গেলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে, যেখানে শেখ হাসিনা ছিলেন, সেই হোটেলে।
তবে আলোর সঙ্গে সব সময় অন্ধকার থাকে। আশার সঙ্গে মিশে যায় কিছু শঙ্কা। কদিন আগেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আবার বিএসএফের গুলি চলল। চোরাচালান, অনুপ্রবেশ—এই ইস্যুতে নিহত হলো বেশ কিছু বাংলাদেশের নাগরিক। আবার গুলি চালানোর ঘটনা ঘটল ৯ জুন। ভারতের আধাসামরিক সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফ বিবৃতি দিয়ে জানায়, এরা চোরাচালানকারী। প্রথমে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। তারপর নন লিথাল অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তারা কিছুতেই শোনেনি। আর সেই কারণে তাদের গুলি চালাতে হয়েছে। আহতদের সংখ্যাও অনেক। এ ঘটনায় বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী আর বিএসএফের বিবাদ আবার বেড়ে গেছে। এই সীমান্ত বিবাদ বা সীমান্ত হত্যা কোনো নতুন ঘটনা নয়, শতকের পর শতক হয়ে চলেছে। কিন্তু যখন শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে চলেছে, যখন শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে। এমনকি শোনা যাচ্ছে, এবারে তিস্তা চুক্তি নিয়েও নতুন করে কথাবার্তা শুরু হতে পারে এই নতুন অধ্যায়ে। এমনও শোনা যাচ্ছে, নেপালের কাছে থেকে বিদ্যুৎ নেওয়ার পাশাপাশি যাতে ভারতের কাছ থেকেও বেশি বিদ্যুৎ ঢাকা পেতে পারে, সে ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। এই রকম একটা ইতিবাচক সম্ভাবনা যখন সামনে, তখন এই সীমান্ত হত্যা, সীমান্ত সন্ত্রাস পরিস্থিতিকে কলুষিত করছে। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
সম্পর্কের মূল্যায়ন করাটাও আজ খুব বেশি জরুরি। এই যে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি, এই তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই একটা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছিল, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অনেকেরই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বিশেষত, মালদ্বীপে যে নতুন শাসক দল, তা সম্পূর্ণ চীনপন্থী আর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হলেন চীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এটা প্রকাশ্যে এসে গেছে। যদিও ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের একাধিকবার বৈঠক হলো এবং এবারেও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সস্ত্রীক হাজির ছিলেন, কিন্তু সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, সেটা কিন্তু এখনো পুনরুদ্ধার হয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। বিশেষত ভারতের যে সেনা মালদ্বীপে এত বছর ধরে থেকেছে, তাদের সরিয়ে দেওয়ার যে দাবি মালদ্বীপ থেকে তোলা হয় এবং আংশিকভাবে সেটা ভারতকে করতেও হয়েছে। কূটনৈতিক মহলের অনেকে মনে করেছে, এর পেছনে আছে চীন।
আর শুধু তো মালদ্বীপ নয়, শ্রীলঙ্কাতেও চীনের ড্রাগনের নিঃশ্বাস সাংঘাতিকভাবে পড়েছে। শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণের দায়ে জড়িয়ে গেছে। সেই ঋণ যে কত বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা শ্রীলঙ্কা বুঝলেও চীনের হাত থেকে এখনো রেহাই পাচ্ছে না। মিয়ানমার সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে চীন পরিকাঠামোগত সাহায্য করেছে এবং চীনের নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমারেও ক্রমেই বাড়ছে। এমনকি ভুটানের মতো ছোট দেশ, শান্তিকামী রাষ্ট্র, সেখানেও ডোকলামে চীনের দখলদারির পর থেকে এখনো পর্যন্ত নানাভাবে চীনের প্রভাব বাড়ছে। ভুটানে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একদা কার্যকর হতো। এখন ভুটান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পথে এগোতে চাইছে। নেপালেও চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো করতে চায় চীন। শেখ হাসিনা অতীতেও চীনে গেছেন, আবার চীনে যাচ্ছেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করবেন না, এমনটা কিন্তু মনোভাব বাংলাদেশেরও নয়। বরং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর করে যাওয়া যে পররাষ্ট্রনীতি—আমরা কোনো শক্তিধর রাষ্ট্রের বশংবদ হব না। তার পররাষ্ট্রনীতিকে কায়মনোবাক্যে মেনে নিতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে থাকবে না। আবার আমরা কোনো দুটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যে সংঘাত এবং দুটি দেশের মধ্যে যে কলহ, তার মধ্যে কোনো একটি দেশের তল্পিবাহকে পরিণত হব না। আবার তাদের যে ঝগড়া, সেই ঝগড়ার মধ্যে আমরা ঢুকব না। তার ফলে চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রাখছে বাংলাদেশ। আর সেটা নিয়ে কিন্তু ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, সেটা শেখ হাসিনা করতেই পারেন।
তবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের যাতে অবনতি না হয়, সেই সম্পর্ককে যাতে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে ভারত আরো বেশি তৎপর হতে চাইছে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে যেসব জায়গায় জটিলতা আছে, সেই জায়গাগুলোকে এবারে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারত নতুন উদ্যমে সংশোধন করতে চাইছে। একটি জিনিস ভারত এবারে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়ও টের পেয়েছে, বাংলাদেশে শুধু জামায়াতিদের মধ্যে নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভারতের বিরুদ্ধে একটা পুঞ্জীভূত অসন্তোষ জমা হয়েছে। বহু ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থকে দেখছে না। অথচ বাংলাদেশ ভারতে সন্ত্রাস দমন থেকে শুরু করে অন্যান্য বহু বিষয়ে অনেক বেশি সক্রিয় সহযোগিতা করছে। এমন একটা পারসেপশন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে, যেটা বিএনপি এবং জামায়াত আরো বেশি করে উসকে দিচ্ছে।
যদিও ভারত মনে করে, স্থলসীমান্ত চুক্তি থেকে বাংলাদেশের কভিড সংকট মোকাবেলা পর্যন্ত সব বিষয়ে বাংলাদেশকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে ভারত। তবে আরো অনেক বেশি করা প্রয়োজন। সেটা কিন্তু নরেন্দ্র মোদি অনুভব করছেন। এইভাবে এখন নতুন উদ্যমে, নতুন উৎসাহে ভারত ও বাংলাদেশ এগোচ্ছে। এবার শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনা হবে। কিন্তু এরই মধ্যে সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের এবং স্মাগলিংয়ের বিষয় নিয়ে যে হিংসাত্মক ঘটনা, তা কিন্তু একটা প্রভাব ফেলছে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে। সুতরাং এ বিষয়টা, যদিও এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, এটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তাহলেও দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করে দ্রুত বিষয়টির নিরসন হওয়া প্রয়োজন। কেননা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় হলেও, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, কূটনীতির ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাংস্কৃতিক সম্পর্কে, দুই দেশের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কে এর প্রভাব পড়ে, যেটিকে আমরা সফট ডিপ্লোম্যাসি বলে থাকি। এই সফট ডিপ্লোম্যসির ক্ষেত্রেও কুপ্রভাব পড়তে পারে। আর তাই এ ব্যাপারে ভারতকেও অবিলম্বে সচেতন হতে হবে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন