ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতিউর রহমান ও তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের সম্পদ জব্দের প্রস্তুতি নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শিগগিরই তাঁদের ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, বাড়ি, গাড়ি ও কারখানা ক্রোক করতে এবং ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করতে আদালতে আবেদন করা হবে। পরে আদালতের আদেশে মতিউরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করবে দুদক। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে মতিউর রহমান ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আগামী ৩০ দিনের জন্য মতিউরসহ তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের আটটি ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত সোমবার দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর রহমান, তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। যদিও এর আগের দিন গত রবিবার বিকেলে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ছদ্মবেশে মতিউর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, অনুসন্ধানকারী টিমের আবেদনের পর মতিউর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী ও ছেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে টিম পরবর্তী আইন ও বিধি অনুসারে সব কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
চলতি বছর ঈদুল আজহার সময় মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মুশফিকুর রহমান ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরে মতিউরের সম্পদের বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
এর আগে গত ৪ জুন কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
জানা গেছে, এর আগেও চারবার মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেছে দুদক। প্রতিবারই তিনি দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি দুদক। তবে এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব জানিয়েছেন, চারটি পুরনো অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছিল। তবে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরনো কী কী অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন—সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন।
দুদক সূত্র জানায়, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের তথ্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে নগদ অর্থ, মেয়াদি আমানতসহ সব কিছুই আছে তাঁর নামে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় মতিউরের নামে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অন্য স্থাবর সম্পদও রয়েছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। এ দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা রয়েছে। এসব সম্পদ শিগগিরই জব্দ করা হবে।
সূত্র আরো জানায়, মতিউর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবাধে দুর্নীতি করেছেন। তাঁর নামে-বেনামে ঢাকায় বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। দুর্নীতিসংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ রেখেছেন তিনি। বসুন্ধরার ডি ব্লকের ১ নম্বর রোডে পাঁচ কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়ি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় তিনি থাকেন। বাকি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। ময়মনসিংহের ভালুকার প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর তাঁর রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা রয়েছে। কারখানাটির নাম গ্লোবাল শুজ। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় মতিউরের রয়েছে বিপুল সম্পদ, প্লট ও বাগানবাড়ি। জেসিএক্স নামের একটি যৌথ ডেভেলপার কম্পানিতে তাঁর মালিকানা রয়েছে। গাজীপুর সদরের খিলগাঁও মৌজায় বিপুল জমি রয়েছে তাঁর। সাভার থানার বিরুলিয়া মৌজায় আটটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ এবং একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৪.০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। গ্লোবাল শুজ কম্পানির নামে সাতটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাঁদের নামে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো সম্পদের তথ্য পেলে কমিশনের অনুসন্ধান টিম সেসব সম্পদও জব্দের উদ্যোগ নেবে।
মতিউরের ব্যাংক ও বিও হিসাব স্থগিত
এদিকে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউর রহমান ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আগামী ৩০ দিনের জন্য মতিউরসহ তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের আটটি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুদকের নির্দেশনার পর আর্থিক খাতের এ গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
বিএফআইইউয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মতিউর রহমান, তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধুরী, দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত, প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান (ঈপ্সিতা), প্রথম স্ত্রীর ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইরফানুর রহমান ইরফানের মোট আটটি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে এসব ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি ও লেনদেন বিবরণীর তথ্যাদি সরবরাহের জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ। আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থাটির পাঠানো এসংক্রান্ত চিঠি বাংলাদেশে কার্যরত সব শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ারবাজারে মোট ১৬টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশের পর এসব বিও হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দুদকের পক্ষ থেকে মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ারবাজারে থাকা বিও হিসাব জব্দের জন্য আবেদন জানানো হয়। দুদকের ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি এসব বিও হিসাব জব্দের ব্যবস্থা নেয়।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন