পাসপোর্টেও জালিয়াতি বেনজীরের, আট কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের পাশাপাশি ‘নজিরবিহীন’ পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগও অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে বেনজীরের পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পরিচয় গোপন করে সাধারণ পাসপোর্ট নেওয়ার নজিরবিহীন জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। 

বেনজীরগতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

দুদকের উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধানদল এ পর্যন্ত বেনজীরের সাতটি পাসপোর্টের সন্ধান পেয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

 

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে দুদকের অনুসন্ধান টিম আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাঁরা হলেন মো. মহসিন ইসলাম, আবু মো. মোতালেব হোসেন, আব্দুল জলিল মণ্ডল, মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, আবু নাঈম মামুন, সাইদুর রহমান ও সুবাস চন্দ্র রায়।

 

বেনজীরের নজিরবিহীন পাসপোর্ট জালিয়াতি
পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রেও বেনজীর আহমেদ আশ্রয় নিয়েছেন নজিরবিহীন জালিয়াতির। পুলিশ পরিচয় গোপন করে বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট তৈরি করেন তিনি। কিন্তু নবায়নের সময় ধরা পড়লে তা আটকে দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। চিঠি দেওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে।

কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে সব ম্যানেজ করেন বেনজীর। পাসপোর্ট অফিসে না গিয়ে নেন বিশেষ সুবিধা। বানিয়ে নেন সাধারণ পাসপোর্ট। এমনকি শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে বিশেষ পাসপোর্টও (লাল পাসপোর্ট) নেননি বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। 

 

জানা যায়, ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর বেনজীরকে নবায়ন করা এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) দেওয়া হয় (নম্বর এএ১০৭৩২৫২)।

মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর। মেয়াদপূর্তির আগেই ২০১৪ সালে ফের তিনি পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন। কিন্তু এবারও যথারীতি নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী বলে পরিচয় দেন। বেনজীর তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেই তিনি অফিশিয়াল পাসপোর্ট নেননি। 

 

দ্বিতীয় দফায় তাঁর নবায়ন করা পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (পাসপোর্ট নম্বর বিসি ০১১১০৭০)। পরে ২০১৬ সালে তিনি ফের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন জমা দেন। ওই সময় তিনি ছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক। এবারও যথারীতি তিনি বেসরকারি পাসপোর্টের আবেদন করেন। তখনই ধরা পড়ে তাঁর তথ্য গোপন ও জালিয়াতির ঘটনা। ২০২০ সালে ৩০তম আইজিপি হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন বেনজীর। নিয়ম অনুযায়ী, সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কূটনৈতিক পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি মর্যাদাপূর্ণ লাল পাসপোর্টও নেননি। আইজিপি হয়েও তিনি ফের বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। কিন্তু তত দিনে দেশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ই-পাসপোর্ট চালু হওয়ায় বেনজীরের আবেদন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এ সময় বেনজীর আহমেদ আবারও আশ্রয় নেন নজিরবিহীন প্রতারণার। চলাচলে অক্ষম হিসেবে গুরুতর অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ডিআইপির মোবাইল ইউনিট চেয়ে পাঠান। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাঁর বাসায় গিয়ে ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ নেওয়াসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। অতিগোপনে করা হয় এসব কাজ। ২০২০ সালের ৪ মার্চ তাঁর আবেদনপত্র জমা হয়ে যায়। আর ১ জুন বেনজীরের নামে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় (নম্বর বি০০০০২০৯৫)।

বেনজীর পরিবারের সাত পাসপোর্ট
অনুসন্ধানে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের এ পর্যন্ত সাতটি পাসপোর্টের সন্ধান পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধানদল। এগুলো হলো পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৬১৬, এএ১০৭৩২৫২, বিসি০১১১০৭০, বিএম০৮২৮১৪১ এবং বি০০০০২০৯৫। এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধানদল বেনজীরের নামে আরো দুটি পাসপোর্টের তথ্য সংগ্রহ করেছে বলে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

একাধিক মামলার প্রস্তুতি
দ্বিতীয় দফায় দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে মুখোমুখি না হয়ে বেনজীর আহমেদ তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে আর সময় দেওয়া হবে না বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য দুদকের আইনে সময় চেয়ে দ্বিতীয়বার আবেদনের সুযোগও নেই। এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই তাঁর ঠিকানায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানো হবে। এরপর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরো ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন তিনি। তবে বিদেশে অবস্থান করায় বেনজীর যেমন দুদকের নোটিশ গ্রহণ করতে পারবেন না, তেমনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতেও ব্যর্থ হবেন। সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে তিনটি মামলা হবে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হবে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা, আর বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে আরেকটি ‘অবৈধ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত) সম্পদ অর্জনের’ মামলা হবে। আর তৃতীয় মামলাটি হবে বেনজীরের নজিরবিহীন পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দুদক আইনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন-সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

বেনজীর পর্তুগালে, পরিবার দুবাইয়ে
গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল সংবাদ প্রকাশের পরপরই স্ত্রীর চিকিত্সার নামে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমায় বেনজীর ও তাঁর পরিবার। সেখান থেকে তাঁরা ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের অধীনে বেনজীরের কেনা মালয়েশিয়ার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর মালয়েশিয়া থেকে সপরিবারে চলে যান দুবাই। সেখানে পরিবারের সদস্যদের রেখে তিনি পর্তুগালে পাড়ি জমান বলে জানা গেছে।

দুদকের ডাকে সাড়া দেয়নি বেনজীর পরিবার
গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাঁদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে ৬ জুন বেনজীর আহমেদ এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। আরেক মেয়ে জাহরা বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি। তবে প্রথম দফায় দুদকের ডাকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ। দ্বিতীয় দফায় ২৩ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ফের দুদকে তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। আর তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের ২৪ জুন তলব করা হয়। দ্বিতীয় দফায়ও বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হননি।

বেনজীরের সম্পদ জব্দে হ্যাটট্রিক
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত তিন দফায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় গত ১২ জুন বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা আরো আটটি ফ্ল্যাট এবং ২৫ একর (৬০.৫ কাঠা) ২৭ কাঠা জমি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থান ঢাকার বাড্ডা ও আদাবরে। জমি নারায়ণগঞ্জ, বান্দরবান ও উত্তরায়। একই সঙ্গে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেসরকারি সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশও দিয়েছেন আদালত।

দ্বিতীয় দফায় গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের আওতায়।

আর প্রথম দফায় গত ২৪ মে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), চারটি ক্রেডিট কার্ড ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দেন।

বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে
সর্বপ্রথম কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। 

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাঁদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন