সরকারের রাজস্ব কর্মকর্তা হয়েও বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত ড. মতিউর রহমান এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের বিরুদ্ধে। জমির দলিল রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু রাজধানীর পূর্বাচলে দলিল রেজিস্ট্রির সময় জমির মূল্য কম দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে পাঁচটি দলিলে ফাঁকি দিয়েছেন এক কোটি ৫৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকার বেশি রাজস্ব।
ছেলের ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরুর পর থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে মতিউর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের শত শত বিঘা জমি, একাধিক ফ্ল্যাট-বাড়ি, পার্ক-পিকনিক ও শুটিং স্পটের তথ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের কামতা মৌজায় পৃথক তিনটি দলিলে ৪৬.১৭ শতক (প্রায় ২৮ কাঠা) জমি কেনেন মতিউর রহমান। তার মধ্যে প্রথম দলিলটি (নম্বর ১৪৮৫৭) রেজিস্ট্রি করেন ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ওই দলিলে ৩৩ শতাংশ (২০ কাঠা) জমির দাম লেখা হয় ৯০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দলিলে (নম্বর ২৩২২) ৯ শতক জমির মূল্য ১১ লাখ এবং ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট রেজিস্ট্রি করা তৃতীয় দলিলে (নম্বর ১০৫৮১) ৪.১৭ শতাংশ জমির মূল্য উল্লেখ করা হয় পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকা।
বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য দেখিয়ে মূল্যবান এসব জমির দলিল করেন মতিউর। কামতা মৌজার এসএ সিএস ১২৬ ও আরএস ১৫১ দাগের ওই জমি বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূর্বাচল নতুন শহরের ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর সেক্টরের মধ্যে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা গাজীপুরের নাগরী ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুল কাদিরের চাচাতো ভাই মো. মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, ড. মতিউর রহমান জমি কেনার সময় কামতা মৌজায় প্রতি কাঠা জমির মূল্য ছিল অন্তত ৩০ লাখ টাকা। ওই হিসাবে ৪৬.১৭ শতাংশ জমির দাম ছিল আট কোটি ৪০ লাখ টাকা।
অথচ মতিউর দলিলে জমির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র এক কোটি ছয় লাখ ১০ হাজার টাকা। তিন দলিলে তিনি রাজস্ব দিয়েছেন ৯ লাখ দুই হাজার টাকা। ওই সময় উৎস কর, স্থানীয় সরকার ফি, স্ট্যাম্পের মূল্য ও রেজিস্ট্রি ফি বাবদ তাঁকে রাজস্ব দিতে হতো দলিলে উল্লেখ করা মূল্যের সাড়ে ৮ শতাংশ। এতে আট কোটি ৪০ লাখ টাকার জমির রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে তিনি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন অন্তত ৬২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
জানা গেছে, পূর্বাচলের ২০ ও ১৬ নম্বর সেক্টরে মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের পাঁচ কাঠা আয়তনের দুটি প্লট রয়েছে। ২০ নম্বর সেক্টরের ১১১/ই সড়কের ৭ নম্বর প্লটটি নিজ মেয়ে ফারজানা রহমানের (৩২) কাছ থেকে ২০২১ সালে (দলিল নম্বর ১৩৪০৯) এবং ১৬ নম্বর সেক্টরের ৩০২ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর প্লটটি ২০১৯ সালে (দলিল নম্বর ১৬৩) ঢাকার আজমপুর এলাকার মুনসুর হাসান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনেছেন তিনি। বিক্রেতারা আমমোক্তারনামা দলিলমূলে মালিক হয়ে লায়লা কানিজের কাছে সাফ কবালায় বিক্রি করেন। দলিলে প্রতিটি প্লটের ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১২ লাখ টাকা করে। স্থানীয় লোকজন জানায়, প্লট কেনায় বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন ড. মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজও।
দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০ নম্বর সেক্টরের ১১১/ই সড়কের ৭ নম্বর প্লটটির মালিক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গোবিন্দপুর গ্রামের মৃত আফতাব উদ্দিনের ছেলে মো. আরফিন (৫৬)। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক ২০০৫ সালে তাঁকে প্লটটি বরাদ্দ দেয়। ২০১৩ সালের ২০ মে লায়লা কানিজের মেয়ে ফারজানা রহমান প্লটটি কেনার জন্য মো. আরফিনের সঙ্গে বায়নাচুক্তি দলিল করেন। রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা দলিলে (দলিল নম্বর ৫৮৬৯) জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় চার কোটি টাকা। চুক্তি রেজিস্ট্রির দিন ফারজানা রহমান বায়না মূল্য বাবদ তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি ১০ লাখ টাকা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার কথা ফারজানার। কিন্তু একই দিনে ফারজানাকে ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন আমমোক্তারনামা দলিল করে (৫৮৭০ নম্বর) দেন প্লট মালিক আরফিন। আমমোক্তারনামা দলিলে দাতা উল্লেখ করেন, কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় প্লট বিক্রয়, দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব না হওয়ায় ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৩৮৪ নম্বর বাড়ির ব্লক ডি, ১০ নম্বর সড়কের বাসিন্দা বাবা মতিউর রহমান ও মা লায়লা কানিজের মেয়ে ফারজানা রহমানকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেন তিনি। বায়না ও আমমোক্তারনামা দলিল করার সময় ফারজানার বয়স ছিল ২১ বছর। দলিলে দলিলদাতা ও গ্রহীতার পেশা উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হলেও ফারজানার পেশা উল্লেখ করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সময় তিনি ছাত্রী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মা লায়লা কানিজ ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর ফারজানা ও আরফিনের কাছ থেকে মাত্র ১২ লাখ টাকায় পাঁচ কাঠার ওই প্লট সাফ কবালায় কেনেন।
পূর্বাচল উপশহরের পাশের বড় কাউ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী রেজাউল করিম বলেন, ২০১৩ সালে যে প্লট চার কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করে বায়না দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে ওই প্লট আট বছর পর কিভাবে ১২ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয় তা বোধগম্য নয়। মূলত ওই প্লটের দাম ওই সময় ছয় কোটি টাকার বেশি ছিল। রাজস্ব ফাঁকি দিতেই দলিলে মূল্য কম দেখানো হয়েছে। তা ছাড়া এত অল্প বয়সে ফারজানা কিভাবে চার কোটি টাকার মালিক হলেন তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবরেজিস্ট্রার বলেন, বায়না দলিলে উল্লেখ করা মূল্যের কমে সাফ কবালা দলিল রেজিস্ট্রির কোনো সুযোগ নেই। মূলত রাজস্ব ফাঁকি দিতেই এটা করা হয়েছে। দলিলে মূল্য ১২ লাখ টাকা উল্লেখ করায় রাজস্ব দিতে হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন মূল্য চার কোটি লেখা হলে রাজস্ব দিতে হতো ৪২ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন লায়লা।
১৬ নম্বর সেক্টরের ৩০২ নম্বর সড়কের ১১ নম্বরের অন্য প্লটটি কেনায় মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন লায়লা কানিজ। ঢাকার আজমপুর এলাকার মুনসুর হাসান ১২ লাখ টাকায় ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি তাঁর কাছে প্লটটি বিক্রি করেন। মুনসুর হাসানের নামে ২০১৬ সালে প্রথমে আমমোক্তারনামা এবং পরের বছর লিজ দলিল করে দেন মূল প্লট মালিক গাজীপুরের কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের পাড়াবর্থা গ্রামের আসাতুন নেছা। ডিপ্লোমেটিক জোন এলাকা বলে পরিচিত ওই সেক্টরে জমি কেনার সময় প্লটটির মূল্য কম করে হলেও ছিল পাঁচ কোটি টাকা। মূল্য কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৫১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দুই প্লটে লায়লা কানিজ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন ৯১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন