পদে পদে দুর্নীতি: বিপুল রাজস্ব ফাঁকি সাদিক অ্যাগ্রোর

মো. ইমরান হোসেন, গবাদি পশুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি। মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী। তাঁর খামারে বিভিন্ন প্রজাতির গরু-মহিষ-উটের দাম হাঁকিয়ে বিক্রি করা হয় কোটি টাকা। তবে ছাগল ইস্যুতে ফার্মটি দেশজুড়ে বিপুল আলোচনায়।

অথচ কর দেওয়ার সময় কোটি টাকায় বিক্রি করা গরুর দাম দেখানো হয়েছে ১৪ হাজার টাকারও কম।

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রদর্শন করা হিসাব অনুযায়ী, সাদিক অ্যাগ্রোর বছরে আয় মাত্র ৮১ লাখ ২১ হাজার ২৬৯ টাকা। সাদিক অ্যাগ্রোর প্রদর্শিত বার্ষিক আয় প্রতিষ্ঠানটির একটি গরু বিক্রির টাকার চেয়েও কম। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশ্লেষকরা।

 

ইমরান হোসেন কর অঞ্চল-৬-এর ১৩১ নম্বর সার্কেলে তাঁর কর রিটার্ন জমা দেন। তাঁর করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর ৫৬৫০৩৭৯১০৬৭০। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৭৩২৩৯৮৯২২১৫। ২০২২-২৩ করবর্ষের নথি সূত্রে জানা গেছে, সাদিক অ্যাগ্রো ছাড়াও তিনি ইমরান হোসেন ফিশ ফার্মের স্বত্বাধিকারী।

 

এ ছাড়া জালালাবাদ স্টিল লিমিটেড, জালালাবাদ স্টিল বিল্ডিং লিমিটেড, জালালাবাদ মেটাল লিমিটেড ও লাকি স্টিল করপোরেশনের পরিচালক। বর্তমানে তিনি রাজধানীর বনানীর ১৩ নম্বর রোডের ই ব্লকের ১০৩ নম্বর বাসায় থাকেন। তবে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা : বাসা নম্বর-৮৬, কলাবাগান।

২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সাদিক অ্যাগ্রোর  মোট বিক্রির পরিমাণ দুই কোটি আট লাখ ১৫ হাজার ২৩৬ টাকা। তবে এই সময়ে তিনি বাছুর কেনা বাবদ খরচ করেছেন ছয় লাখ ১২ হাজার ৪৭০ টাকা।

 

পশুখাদ্য কিনেছেন ৫১ লাখ সাত হাজার ৮১০ টাকার। ওষুধ কেনার খরচ আট লাখ ৬৫ হাজার ৩৬৬ টাকা। কর্মীদের মজুরি দিয়েছেন ১২ লাখ ৭২ হাজার ৪২৫ টাকা। এভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাতে সর্বমোট ব্যয় করেছেন ৮৪ লাখ ৮২ হাজার ৮৩৪ টাকা। এর সঙ্গে অন্য সব খরচ বাদ দিয়ে তাঁর বাৎসরিক আয় ৮১ লাখ ২১ হাজার ২৬৯ টাকা।
কিন্তু তাঁর এই হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার বিশাল ফারাক। শুধু কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেই তাঁর দেড় হাজার পশু বিক্রি হয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্রাহমা, ইন্দো ব্রাজিল, হোলস্টাইন, দেশাল, শাহীওয়ালসহ বেশ কয়েকটি জাতের গরুর পাশাপাশি মহিষ ও ছাগল। এ ছাড়া তাঁর ফার্মে উটও বিক্রি করা হয়।

তাঁর ফার্মে বেশির ভাগই কোটি টাকা দামের গরু। বছরজুড়ে দেড় হাজার গরু বিক্রি করলেও সাদিক অ্যাগ্রোর বছরের আয়ের হিসাবের সঙ্গে করের হিসাব মেলানো দুষ্কর। ইমরানের বিক্রয়ের তথ্যানুযায়ী, দুই কোটি আট লাখ ১৫ হাজার ২৩৬ টাকায় তিনি দেড় হাজার গরু বিক্রি করেছেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি গরুর দাম পড়েছে ১৩ হাজার ৮৭৭ টাকা। বর্তমান বাজারে এই দামে একটি মাঝারি মানের ছাগলও কিনতে পাওয়া যায় না। তাঁর ফার্মের একটি ছাগল ১২ লাখ টাকায় বিক্রির ইস্যুতে পুরো দেশ এখন সরগরম।

অন্তত ১০ লাখ টাকা গড়ে প্রতিটি গরু বিক্রি করলেও দেড় হাজার গরুর দাম দাঁড়ায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে তিনি কর দিতে গিয়ে এই বিশাল অঙ্কের টাকার তথ্য গোপন করেছেন। এর আগেও এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ইমরানের কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত করেছিল। ওই অনুসন্ধানে কর ফাঁকির তথ্য প্রমাণিত হয়েছিল। তবে সিআইসি সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়ে আবার তদন্ত হতে পারে। আগের তদন্তের চেয়ে এখন তাঁর বিষয়ে অনেক বেশি তথ্য হাতে রয়েছে। আগামী সপ্তাহে তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইমরান খুবই চতুর ব্যক্তি। সাদিক অ্যাগ্রো কম্পানি হিসেবে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত হলেও কম্পানির নামে কোনো রির্টান নেই। এ ছাড়া তিনি জটিলতা এড়িয়ে যেতে ব্যাংক হিসাবে খুব বেশি টাকা রাখেন না। সম্ভবত তিনি নিয়মিত বিভিন্ন কৌশলে টাকা পাচার করেন। অথবা আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ কিনে রাখেন।’

সাদিক অ্যাগ্রোর বছরে ৮১ লাখ টাকা আয়কে অবাস্তব বলে মনে করেন কর অঞ্চল ৬-এর কমিশনার মো. লুত্ফুল আজিম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না তাঁর ফাইলে তিনি কিভাবে হিসাব দেখিয়েছেন। এই মুহূর্তে তাঁর ফাইলটা আমার সামনে নেই, ফলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। ঢাকা শহরের ভেতরে এত বড় অ্যাগ্রো ফার্ম আছে সেটাও আমাদের জানা ছিল না। এখন বিষয়টা জানলাম। এখন আমরা অনুসন্ধানে যাব। তবে দুগ্ধখামারের ওপর করহার কম।’

তিনি বলেন, ‘সাদিক অ্যাগ্রোর বিষয়ে আগেও সিআইসি থেকে তদন্ত হয়েছিল। এরপর অ্যাসেসমেন্ট কী হয়েছে তা আমি জানি না।’

ইমরানের দেখানো হিসাব অনুযায়ী, সাদিক অ্যাগ্রোর স্থায়ী ও চলতি সম্পত্তির পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৪ টাকা। ইকুইটি ও দায়ের পরিমাণ ৯১ লাখ ৩২ হাজার ৩৮ টাকা। ব্যাংক দায় ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৬ টাকা। চলতি দায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ ১২ হাজার ৩৪০ টাকা। সর্বমোট ইকুইটি ও দায়ের পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৪ টাকা।

ইমরানের সম্পত্তির বিবরণীতে দেখা গেছে, সাভারের জামুর মুচিপাড়া মৌজায় বিভিন্ন দলিল নম্বরে ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ টাকার জমির মালিকানা রয়েছে তাঁর। একই এলাকার বিলামালিয়া মৌজায় ৬৬ লাখ ১৯ হাজার ৫২৫ টাকার জমির মালিকানা রয়েছে। এ ছাড়া মালিকানা ও পরিচালক হিসেবে ছয় কোটি ২৬ লাখ ২৯ হাজার টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে জালালাবাদ স্টিল বিল্ডিং লিমিটেডে তাঁর মালিকানামূল্য ৪০ লাখ টাকা, জালালাবাদ স্টিল লিমিটেডে এক কোটি পাঁচ লাখ চার হাজার টাকা, জালালাবাদ মেটাল লিমিটেডে এক কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, সাদিক অ্যাগ্রোতে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং জালালাবাদ মেটাল লিমিটেডে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এক বছরে ইমরান সম্মানি বাবদ পেয়েছেন ১৬ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬০ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সুবিধা যোগ করলে তাঁর আয়ের পরিমাণ ২৯ লাখ ২৯ হাজার ৭৬০ টাকা। বেতন বাবদ তাঁর করযোগ্য আয় দেখিয়েছেন ২৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭৬০ টাকা। এ ছাড়া কৃষি খাত থেকে আয় বাবদ (সাদিক অ্যাগ্রো) ৮১ লাখ ২১ হাজার ২৬৯ টাকা, ব্যবসা থেকে আয় করেছেন ৯ লাখ ৯ হাজার ৮৮৩ টাকা, ফার্মের লাভের অংশ হিসেবে পেয়েছেন ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭০ টাকা, অন্যান্য খাত থেকে তাঁর আয় এক লাখ আট হাজার ৭৪৭ টাকা। বছর শেষে তাঁর মোট আয় এক কোটি ২৮ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৯ টাকা। এর বিপরীতে তাঁর প্রদেয় কর ১৭ লাখ ২২ হাজার ৮৯২ টাকা। সেই হিসাবে তাঁর কর দাঁড়ায় ১৮ লাখ চার হাজার ৩৬৬ টাকা। সব ধরনের মওকুফ বাদ দিয়ে তাঁর করের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৩৬৬ টাকা। এই টাকা তিনি ইসলামী ব্যাংকের বংশাল শাখা থেকে চেকের মাধ্যমে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি পরিশোধ করেছেন। চেক নম্বর এমসিএইচ ০৬৮৮১৭৮।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দৃশ্যত এটি যৌক্তিক বলে মনে হয় না। এখানে আয় লুকানোর একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। একটা অবৈধ জায়গায় তারা ফার্ম করেছিল। বছরে ৮১ লাখ টাকা আয় প্রকৃতপক্ষে তাদের বাস্তব আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে সম্ভাব্য বড় কর ফাঁকির ঝুঁকি রয়েছে।’

এসব বিষয়ে বক্তব্য নিতে সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন