ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় আগামী ৫ জুলাই কট্টরপন্থী ও মধ্যপন্থী দুই প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় লড়াই হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাদের মধ্যে কেউ তেহরানের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক বা সক্ষম হবেন কি না। চ্যাথাম হাউস নামে পরিচিত লন্ডনের থিংকট্যাংক রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে জটিলতা, বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটিরর বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
চ্যাথাম হাউসের প্রতিবেদন অনুসারে, গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানের মৃত্যু ইরানের বৈদেশিক নীতি কৌশলে একটি উল্লেখযোগ্য শূন্যতা তৈরি করেছে।
এই দুজনকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান দুই সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করেছে থিংকট্যাংকটি। এ শূন্যতার কারণে ইরান-রাশিয়া সম্পর্কের ভবিষ্যত, যা আরো প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, এখন ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে।
যদি ইরানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার ও ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাঘেরি-কানি সম্পর্কের কৌশলগত প্রকৃতির ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে আগত নেতৃত্ব মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। ‘তবে প্রেসিডেন্ট পদের প্রধান প্রার্থীদের সবাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি ও অর্থনীতির উন্নতি তাদের অগ্রাধিকার, মস্কোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নয়।
’
সর্বোচ্চ নেতার প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রভাব দেশের পররাষ্ট্র নীতি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। থিংকট্যাংক উল্লেখ করেছে, তার পূর্ববর্তী উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচার জন্য ইরানের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দেয়। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে পূর্ব গোলার্ধের দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের কৌশল, জোটের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং পশ্চিমা প্রভাবের প্রতি ইরানের দুর্বলতা হ্রাস।
খামেনির কৌশলগত হিসাব-নিকাশ নির্বাচনের ফলাফল ও বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে বিকশিত হতে পারে বলে চ্যাথাম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তারা বলেছে, ‘এমনকি সর্বোচ্চ নেতাও রাশিয়ার বিষয়ে নীতি পরিবর্তন করতে পারেন, যদি শাসনের স্বার্থে প্রয়োজন হয়।’
ইরানের অর্থনৈতিক সংকট
এদিকে ইরানে গভীর অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশটি একটি বিস্ময়কর অবকাঠামোগত ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে, যার পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই সঙ্গে ক্রমাগত বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার গত পাঁচ বছরে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ইরানের মুদ্রা রিয়ালের তীক্ষ্ণ অবমূল্যায়ন লাখ লাখ ইরানিকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে, আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইরানে বিশাল তেলের রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও পেট্রলের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। এগুলো চলমান অর্থনৈতিক জটিলতাগুলোকে তুলে ধরে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রার্থীরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্প্রসারণ বা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আঞ্চলিক সংঘর্ষ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে খামেনির কৌশলগত নীতিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেননি। ‘বিপ্লবী’ বৈদেশিক নীতি প্রার্থীদের কাছে অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাঈদ জালিলি দ্বন্দ্বমূলক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কট্টর রাজনীতিবিদ।
প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে জয়ী হবেন তাকে দুটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে : অর্থনীতিকে সংকট থেকে বের করে আনা এবং নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশটির ওপর চাপানো বহিরাগত চাপ কমানো।’
চ্যাথাম হাউসের মতে, জালিলি দ্বন্দ্বমূলক অবস্থান নেবেন, শুধু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্যই নয় বরং নিষেধাজ্ঞা প্রদানকারী দেশগুলোকে অনুতপ্ত হতে বাধ্য করার পক্ষেও সমর্থন করবেন।
অন্যদিকে একমাত্র তথাকথিত ‘সংস্কারবাদী’ প্রার্থী পেজেশকিয়ান ইরানের ‘প্রাচ্যের দিকে মোড় নেওয়া’ কৌশলের সমালোচনা করেছেন এবং দেশটিকে পশ্চিমের দিকে উন্মুক্ত করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পেজেশকিয়ান খামেনির প্রতি অনুগত থাকার বিষয়টি ক্রমাগতভাবে বজায় রেখেছেন, যার অর্থ খামেনি যদি ‘প্রাচ্যের দিকে বাঁক’ নেওয়ার কৌশলের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, পেজেশকিয়ান তা অনুসরণ করবেন।
প্রার্থীরা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কমাতে চান
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রাইসির মৃত্যুর পর পরই প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতার ফলাফল দেখতে ক্রেমলিন ইরানে দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোচনায় বিরতি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।’
যদিও রাশিয়া ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে রয়ে গেছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ঠেকানো ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে সমন্বয় সাধনে। পশ্চিমের প্রতি ইরানের পরবর্তী প্রশাসনের অভিমুখ এই গতিশীলতাকে নতুন আকার দিতে পারে : ‘যেকোনো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য তেহরানের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হবে, যদিও তা অবিলম্বে নয়।’
বিপরীতে জালিলি রাশিয়ার সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের জন্য স্বল্প আশাবাদ দেয় বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি ইরানের পররাষ্ট্র নীতি বক্তৃতায় রাশিয়াকে অগ্রাধিকার দেন না, বরং চীন ও ভারতের পাশাপাশি বৃহত্তর ‘প্রাচ্যের দিকে মোড়’ নেপার প্রেক্ষাপটে মস্কোর কথা উল্লেখ করেন।
ব্রিটিশ থিংকট্যাংকের প্রতিবেদনে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপের ওপর নির্ভর করে ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সম্ভাবনার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের তাৎক্ষণিক ও গভীর সংশোধনের কোনো সুযোগ না থাকলেও নতুন প্রেসিডেন্ট যদি নিষেধাজ্ঞা-প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু করতে সফল হন তাহলে বর্তমান ফরম্যাটের বিলুপ্তি মধ্যমেয়াদে খুবই সম্ভব।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন