ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের সুবিধার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশ্বায়নের যুগে আমরা নিজেদের দরজা বন্ধ করে রাখতে পারি না। আজকে পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজ, একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।’
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ট্রান্স-এশিয়া হাইওয়ে, ট্রান্স-এশিয়া রেলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আজকে ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিলাম কেন? এটা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া। আমাদের ট্রানজিট তো আছেই। ত্রিপুরা থেকে বাস চলে আসে ঢাকায়, ঢাকা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত তো যাচ্ছে।
এতে ক্ষতিটা কী হচ্ছে? বরং আমরা রাস্তার ভাড়া পাচ্ছি। সুবিধা পাচ্ছে দেশের মানুষ। অনেকে অর্থ উপার্জনও করছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নেপাল, ভুটান, ভারত, বাংলাদেশ—এই চারটি দেশ নিয়ে প্রতিটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।
আমরা নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট করেছি ভারতে। এটা তো কোনো একটা দেশ না, আঞ্চলিক ট্রানজিট সুবিধা এবং যোগাযোগ সুবিধার জন্য করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নেপাল থেকে আমরা জলবিদ্যুৎ কেনা শুরু করতে যাচ্ছি, সেখানে গ্রিডলাইন করা, আমরা সেই চুক্তি করেছি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর যেসব রেলপথ, নৌপথ বন্ধ ছিল, সেগুলো আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভুটান থেকে একটি রাস্তা যাচ্ছে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত।
অথচ সেই রাস্তা যাচ্ছে বাংলাদেশকে বাইপাস করে। বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে যে রোড হচ্ছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন, কেন আমরা বিচ্ছিন্ন থাকব? ভারত চাচ্ছিল ভুটান থেকে এই রাস্তাটা বাংলাদেশ হয়ে, ভারত হয়ে, মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ—সব কিছুতে কত সুবিধা হতো। সেটাও খালেদা জিয়া নাকচ করে দিয়েছিল। আমি প্রথমবার সরকারে এসে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা যুক্ত হতে পারিনি।’
ভারত থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা আসামের রুমালিগড় থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে এসেছি। পার্বতীপুর ডিপোতে সেই তেল আসছে। ক্ষতিটা কী হয়েছে? বরং আমরাই সস্তায় কিনতে পারছি। উত্তরাঞ্চলে কোনো শিল্পায়ন হয়নি, এখন শিল্পায়নে আমরা যেতে পারি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও আমরা নির্মাণ করেছি। আমরা নিজেদের দরজা তো বন্ধ রাখতে পারি না।’
খালেদা জিয়া মিয়ানমার থেকে গ্যাস আনার সুযোগ নষ্ট করেছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কী সমস্যা দেশের জন্য করেছে দেখেন—মিয়ানমারের গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস; ভারত, চীন, জাপান সবাই চাচ্ছে। এই গ্যাস বাংলাদেশের ভেতর থেকে ভারতে নিয়ে যাবে, এই নিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্যাস থেকে আমরা একটা ভাগ নেব। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামসহ ওই এলাকায় আমাদের গ্যাসের কোনো অভাবই হতো না। খালেদা জিয়া সেটা নিতে দেয়নি। কেন দেয়নি?’ তিনি আরো বলেন, ‘আজকে সেই গ্যাস নিচ্ছে চীন। আর কোনো দেশ তো নিতে পারছে না। আমরা সরকারে আসার পর কথা বলেছিলাম মিয়ানমারের সঙ্গে, আনতে পারি কি না। কিন্তু সম্ভব হয়নি, তারা অলরেডি দিয়ে দিয়েছে।’
ভারত সফর নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি কিছু লোক আমার ভারত সফর নিয়ে নানা কথা তুলেছে। ১৯৮১ সালে ছয় বছর পর দেশে ফিরে আসার পর তখন এই একই কথা শুনতে হয়েছে। এখন জানি না কেন সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাতে শুরু করল।’
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমরা গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ভোট বেশি পেলেও ২০০১ সালে সিট বেশি পাইনি। এ জন্য সরকার গঠন করতে পারলাম না। কারণ আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি। তো বিক্রিটা করে কে দেশকে? করে গেছে তো খালেদা জিয়া, করেছে এরশাদ সাহেব। করেছে জিয়াউর রহমান। এরাই করে গেছে, আওয়ামী লীগ করে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাজারটাকে ভারতীয় পণ্যের বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। ৪০টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার দিয়ে দেয়। ১৯৮০ সালে গ্যাস বিক্রির চুক্তিও করে আসে। ১৯৯২ সালে ভারতে গেল খালেদা জিয়া। সেখানে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে ভারতে অনুপ্রবেশ করার কথা স্বীকার করে নেয়। তার পরে পুশ ইন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বহু মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সংসদে দাবিও করেছিলাম, কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি।’
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়কার ভারত সফরে দেশের জন্য কোনো কিছুই আনতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন সরকারপ্রধান। দলগুলোর কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ভারত-বাংলাদেশের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিচুক্তি, ছিটমহল বিনিময় ও তিন বিঘা করিডর উন্মুক্ত হয়েছে। অথচ খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমান—কেউ এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেননি, করেননি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। এত দিন তো গণতন্ত্র সেনানিবাসে বন্দি ছিল। সারা রাত হতো কারফিউ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরেই গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের হাতে ফিরে এসেছে। জনগণ আমাদের ভোট দিচ্ছে, আমরা জয়ী হচ্ছি। অত্যাচার-নির্যাতনের কথা শুনি। আমাদের কোন নেতাকর্মী বাকি ছিল নির্যাতনের হাত থেকে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে?’ তিনি বলেন, ‘সবাই কথা বলছে, জনসভা করছে, মিছিল করছে, বত্তৃদ্ধতা করছে। আমরা রেডিও, টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বেসরকারিভাবে। ইচ্ছামতো টক শো করছি। আমরা তো কারো মুখ চেপে ধরছি না, গলা চিপেও ধরছি না। যে যা পারছে, বলতে পারে বলুক। আমরা রাষ্ট্র চালাচ্ছি, জনগণের কল্যাণে কাজ করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমরা কাজ করছি। সামাজিক নিরাপত্তা, আবাসন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে আওয়ামী লীগ সরকার। গ্রাম ও শহরে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনসহ গ্রাম ও শহরে নতুন এক লাখ গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকায় বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করে বিনা মূল্যে ঘর প্রদান এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে আশ্রিতদের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের সামাজিক মর্যাদা ও জীবনযাপনের মান বৃদ্ধি পেয়েছে। স্যানিটেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।’
সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া গৃহহীনদের অনুভূতির ভিডিও চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই অসহায় মানুষের কথাগুলো যখন শুনি, তখন খুবই ভালো লাগে। মনে হয়, আমার বাবা এমন দেশই চেয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরপ্রাপ্তির পর পুনর্বাসিত পরিবারের আয় প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরপ্রাপ্তির আগে উপকারভোগীরা ২০১৭ সালে ২৪.৬৭ শতাংশ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করত, যা ২০২২ সালে ঘরপ্রাপ্তির পর ৯৪.৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের খাদ্য বাবদ ব্যয় আগের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঋণ প্রদানসহ তাদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমলাদের নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে অনেক দোষ দেয়। কিন্তু আমি দেখেছি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সময়ে যারা একেবারে তরুণ (কর্মকর্তা), তাদের ভেতরে যে আন্তরিকতা, তাদের কাজ করার যে আগ্রহ, সেটা সত্যিই আমাকে আশার আলো দেখায়। সবাই মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করেছে। এই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তো দরকার। এ ধরনের অফিসার তো আমাদের দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার হারানোর কিছু নেই। পাওয়ারও কিছু নেই। আমার একটাই লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেশকে উন্নত করে দেওয়া। সেটাই আমি করতে চাই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। এ জন্য আমি সবার সহযোগিতা চাই। আমাদের নবযাত্রায় আরো সাফল্য আসুক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বাংলাদেশের মানুষ আরো উন্নত সুন্দর জীবন পাবে।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন