কামরুল-সাবরিনার অন্তরঙ্গতা সবার মুখে মুখে

কামরুল-সাবরিনার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের বিষয় তাদের কর্মস্থল থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও চিকিৎসক মহলে এখন ওপেন সিক্রেট। সবার মুখে মুখে শুধু কামরুল-সাবরিনার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কাহিনী।

জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে করোনা টেস্টের সনদ প্রতারণার অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করেছে। বর্তমানে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের জেরার মুখে আছেন। কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. কামরুল হাসানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ডা. সাবরিনা।

কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের ইউনিট-৩ প্রধান প্রফেসর ডা. কামরুল হাসানের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে সাবরিনার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অভিযোগ ছিল। সাবরিনা প্রফেসর কামরুলের অধীনেই কর্মরত আছেন।একটি অনুষ্ঠানে তাদের দুজনের নাচের একটি ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে হিন্দি গানের সঙ্গে কামরুল ও সাবরিনাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে নাচতে দেখা গেছে। ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পরে বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডা. কামরুল ও ডা. সাবরিনার চেনাজানা অনেক বছরের। পরিচয়ের পর থেকে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। কৌশলে তারা একই ইউনিটে দায়িত্বও নেন। একই ইউনিটে কাজ করার সূত্রে দুজন খুব কাছাকাছি থাকতেন। অভিযোগ আছে সাবরিনা উপস্থিত না হলেও তার হাজিরা উঠে যেত। দিনের পর দিন অফিস ফাঁকি দিয়েও সরকারি বেতন নিয়েছেন। অফিস করেছেন নিজের খেয়ালখুশি মতো।

সাবরিনার প্রতি দুর্বল হওয়াতে তার অনুপস্থিতির বিষয়ে কিছুই বলতেন না ডা. কামরুল। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাবরিনা যতক্ষণ অফিসে থাকতেন ততক্ষণ তিনি কামরুলের কক্ষেই থাকতেন। সাবরিনা তার কক্ষে এলে কাউকে প্রবেশ করতে দিতেন না কামরুল। শুধু অফিস নয় বাইরেও তাদেরকে একসঙ্গে দেখেছেন অনেকে। সাবরিনা গ্রেপ্তারের কিছুদিন আগেও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী একটি রেস্টুরেন্টে তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখা গেছে।

কামরুল ও সাবরিনাকে আপত্তিকর অবস্থায় পেয়ে সাবরিনার স্বামী কামরুলকে মারধর করেছিলেন বলেও আলোচনা আছে। এ ঘটনায় সাবরিনা শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডিও করেছিলেন। পরে পুলিশ তদন্ত করতে গেলে সাবরিনা জানান তারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলেছেন।

সূত্রমতে, তাদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর ঘটনা নতুন কিছু নয়। মূলত কামরুলের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতেন। কামরুলও তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। ২০১৫ সাল থেকে আরিফ চৌধুরী তার দাদির নামে জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। এটি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। বিএমএ নেতা ডা. কামরুলের প্রভাবেই সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফের প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দিবস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমএ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ পেয়ে আসছিল।

সর্বশেষ তারা করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পেয়েছিল। ট্রেড লাইসেন্সের আগেই কোনো রকম বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই স্পর্শকাতর এই কাজটি পেতে সাবরিনা কামরুলকেই ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তিতুমীর কলেজে একটি মাত্র বুথ স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল জেকেজি। কিন্তু তাদের টার্গেটই ছিল প্রতারণা করে টাকা উপার্জন। কারণ তারা অল্প ক’দিনের ভেতরে ১টি বুথ থেকে ৪০টি বুথ স্থাপন করেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নমুনা সংগ্রহের কোনো টার্গেট না দেয়ায় তারা নিজেদের ইচ্ছামতো নমুনা সংগ্রহ করতো। বিনামূল্যে কাজটি করার কথা থাকলেও তারা সেটি করেনি। বরং ইচ্ছামতো নমুনা সংগ্রহ করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো সনদ জালিয়াতি করে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

শুধু তাই নয়, বুথ স্থাপনের জন্য আর্চওয়ে, ওয়াকিটকি, ল্যাপটপসহ আরো কিছু জিনিস তারা ভাড়ায় নিয়েছিল। কিন্তু এসব ভাড়ার এক টাকাও তারা পরিশোধ করেনি। সূত্র বলছে, সাবরিনা ও আরিফ দম্পতির অবৈধ সকল আয় থেকেই একটা বড় ধরনের ভাগ পেতেন ডা. কামরুল। এজন্য সাবরিনার সকল কাজেই তিনি সহযোগিতা করতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. কামরুল হাসান মিলন ছাত্রলীগের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র জীবন থেকেই কামরুল ছিলেন বেপরোয়া। নেশার জগতে ডুবে থাকতেন। ২০০০ সালে আগারগাঁও পাকা মার্কেটে কয়েকজনের সঙ্গে থাকা অবস্থায় পাগলা তপন নামের এক সন্ত্রাসী তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। ওই গুলি কামরুলের বুকে লেগেছিল। পরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। নেশার আসরে ওই গুলির ঘটনাটি ঘটেছিল বলে তখন আলোচনা ছিল।

হৃদরোগ ইন্সটিটিউট সূত্র জানিয়েছে, ডা. কামরুল হাসান মিলন একসময় কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ওই সময় তিনি বিভাগীয় প্রধানের জন্য নির্ধারিত কক্ষটি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান করা হয় অধ্যাপক ডা. রামপদ সরকারকে। কিন্তু রামপদকে বিভাগীয় প্রধান করার পরেও কামরুল বিভাগীয় প্রধানের কক্ষটি ছাড়েননি। এমনকি তার নেম প্লেটে নামের পাশে বিভাগীয় প্রধানের পদবিও সংশোধন করেননি।

ডা. রামপদ সরকার ছোট্ট একটি কক্ষে বসে তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফরা জানিয়েছেন, ডা. কামরুল শুধু বিভাগীয় প্রধান রামপদ সরকারকে কোণঠাসা করে রাখেননি। তিনি হাসপাতালের সর্বত্রই প্রভাব বিস্তার করতেন। কামরুল-সাবরিনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে সবাই জানতো। কামরুলের নানা অনিয়মের বিষয়ে জানার পরও তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতো না কেউ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান মিলন মানবজমিনকে বলেন, এটা একটা জঘন্য ঘটনা। আরো ৪-৫ জন চিকিৎসক আমার সঙ্গে যেভাবে ছিল সাবরিনাও একইভাবে ডিউটি করতো। রেজিস্ট্রার মানে হলো- পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করা, ডিপার্টমেন্টাল হেডদের সঙ্গে বসা ও অপারেশন থিয়েটারে অংশ নেয়া। এটা একটা একাডেমিক পরিবেশ।

নাচের ভিডিও নিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের। এসব প্রোগ্রামের শেষদিকে কালচারাল একটা পার্ট থাকে। সেখানে গান নাচ, কবিতা, নাটকের ব্যবস্থা থাকে। তখন ছাত্রছাত্রীদের দাবি থাকে শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে পারফর্ম করবে। সেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও ছিল। তাদের বলাতেই পারফর্ম করতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের অ্যালামনাইতে ৭০ বছরের চিকিৎসককেও শিক্ষার্থীরা পারফর্ম করতে বলে। বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, একটি কুচক্রী মহল এসব ছবি, ভিডিও বের করে আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষের জীবনে তো কত দুর্ঘটনাই থাকে। তাই আমরা মূল জায়গাটাতে থাকি, এটা জাতীয় ক্রাইসিস।

বিভাগীয় প্রধানের কক্ষ দখল নিয়ে তিনি বলেন, আমি ছিলাম বিভাগীয় প্রধান। কিন্তু অন্যায়ভাবে আমার অধীনস্থ চিকিৎসককে বিভাগীয় প্রধান বানানো হয়েছে। আমাকে ইউনিট-৩ প্রধান করা হয়েছে। সেগুলো আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। এ নিয়ে আমি একটি রিট করেছিলাম। সেই রিটটা এখনো সুরাহা হয়নি।

এদিকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ওই মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার তেজগাঁও বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতারণার এই মামলায় গতকাল তাকে ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবরিনা জেকেজির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করছেন। এছাড়া আরো বেশ কিছু বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল যেগুলো তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিছু কিছু বিষয় অস্বীকার করছেন। তাই তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে এই মামলায় রিমান্ডে আনা হবে। রিমান্ডে এনে তাদেরকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

মামলার আগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ডিএমপির তেজগাঁও ডিভিশনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহমুদ খান বলেন, প্রতারণার মামলায় ডা. সাবরিনা চৌধুরীর তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল। কিন্তু মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন এই মামলায় তদন্ত করবে ডিবি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, প্রতারণা মামলায় ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা বিভাগের একটি টিম। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো তিনি অস্বীকার করছেন। তাই এই মামলায় তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে রিমান্ডে এনেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন