খোদ বায়তুল মোকারমের খতিব সাহেবের ততগুলি সেজদার ছবি গণমাধ্যমের মাধ্যমে জাতির দেখার সৌভাগ্য হয়নি যতগুলি সেজদার ছবি ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলী দিয়েছেন। গাড়ীর স্টিয়ারিং-এ, প্লেনে, সমুদ্র সৈকতের বালুর বেলাভূমিতে কিংবা হাঁটতে হাঁটতে- ডজন খানেক সেজদার ছবি ভাইরাল হয়েছে। এই সব দেখতে দেখতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহুল আলোচিত লালসালু উপন্যাসের পরিচিত মুখ মজিদের চরিত্রই মানসপটে ভেসে উঠছে। প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস করে যত টাকা পেয়েছেন তা সবই আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিয়েছেন!- ভন্ড মজিদও বোধহয় এতবড় ভন্ডামীপূর্ণ কথা বলেননি। ঘৃন্যতর অপরাধ করেও সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে ধর্মের আশ্রয় পাওয়ার কী জঘন্য চেষ্টা। ছাগলকান্ডের হোতাও নাকি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের গ্রুপে রোজ রোজ কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ছড়িয়ে দিয়ে ন্যায়-নীতির কথা শোনাতেন। আবার কেউ কেউ অধীনদের শুদ্ধাচার-সততার বয়ান দিয়ে দিয়ে লুটপাট-লোপাটের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। শস্যের চেয়ে চুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র এই উক্তির যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাল্যকালে পড়েছিলাম তা আজ হাতে-কলমে দেখছি।
হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, সমাজে দুর্নীতি বেড়ে গেলে ধর্মচর্চা বেড়ে যায়। অতীত ও বর্তমানের দুর্নীতিবাজদের ক্ষেত্রে এ উক্তি অনেকাংশেই সত্য হিসেবে ধরা দিয়েছে। অফিসের ঘুষখোর কর্মকর্তার মুখে লম্বা দাঁড়ি। অবৈধতার ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে সততা ও সাধুতার নসিহত। অন্যায়-জুলুম করে আবার সিজদাতে কপালে দাগ ফেলে দেওয়া- দুর্নীতিবাজরা এই পথে কেন হাঁটে? এর অনেকগুলো কারণ হতে পারে। প্রথমত : চোর জানে সে চোর কিন্তু অন্য কেউ যাতে বুঝতে না পারে, চোর সেজন্য আলাদা খোলস গ্রহন করে যাতে মানুষ তাকে মুনশী মনে করে। লেবাসধারী শয়তানের এ তরিকা অনেকটাই সফল! দ্বিতীয়ত : অপরাধ করতে করতে অপরাধীর মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। সে জন্য দুর্নীতিবাজ অপরাধ এবং ধর্মকর্ম সমান্তরালে করে। নয়তো ঘুষ-দুর্নীতি করে কিছু টাকা কামিয়ে সেখান থেকে আট-দশ লাখ খরচ করে হজ্জ্ব করা, লাখ লাখ টাকা দান-সদকা করার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নাই। যখন দুর্নীতিবাজ ভাবে দান-সদকা তাকে মুক্তি দেবে তখন সে দ্বিতীয়বার বোকামি করে! সে আল্লাহকে বলে, আমি তোমার রাস্তায় অনেক কিছু দান করলাম! আল্লাহ বলে, তোমার দান থেকে কিছুই গ্রহন করা হলো না! দোযখ বলে এসো, আমাদের দেখা হবে। পরের হক মেরে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করলেও সুখ মিলবে না এবং কোন তওবাতে পাপ কাটা যাবে না যতদিন যারা অধিকার হারা হয়েছে তারা ক্ষমা না করবে।
ভন্ডদের এই যে সাধুত্ব-দরবেশের মুখোশ এতে সাধারণ, সহজ-সরল মানুষ বিব্রত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা প্রকৃতপক্ষেই ধার্মিক তাদের দিকেও সন্দেহের আঙুল ওঠে। কেননা সহজাতভাবেই সরল মানুষের ধর্মপ্রাণা লোকসকলের জন্য কোমল অনুভূতি থাকে। ভন্ড-ভাঁওতাবাজরা তাদের আসল চরিত্রের আড়ালে সেই সফেদ মুখোশ জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপ করে। মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করে, সরকারি ও দরকারি সেবার চড়া বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরীহ জনতাকে শোষণ করে এবং ন্যায্য অধিকার হারা করে। বাইরের জগতে জামাতে নামাজ আদায়ের বাহানা দেখায়, জোরকদমে এগিয়ে গিয়ে দান-দক্ষিণা করে এবং লোক দেখানো সেজদায় মস্তক অবনত করে। মনের মধ্যে থাকে অবৈধভাবে শতকোটি টাকা কামাইয়ের বাসনা, গাড়ি-বাড়ির নেশা এবং নারীর প্রেষণা। অন্যায় করতে করতে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সে যোগ্যদের স্বপ্ন খুন করে, প্রাপ্যকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং প্রকৃতির থেকে কেড়ে লয়।
মনে মনে মজিদ সেজে থাকাদের অল্প গল্পই লোকালয়ে বের হয়। ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলীতে চাপা পড়ে তার মালিক। কিংবা যারা মতিউরদের মালিক বানালো সেই বাহনদের অনেকেই গল্পের চিত্রায়নের বাইরে থেকে যায়। নির্ধারিত বেতনে চাকুরি করে যারা অতিরিক্ত ফুটানি করে, কর্মকালেই আলিসান বাড়ি কিংবা সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং প্রস্থান-আগমনের এলাকায় সীমাহীন প্রতাপ ছড়ায়- তাদের ক’জনের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ক্ষতিয়ে দেখা হয়েছে সম্পদের উৎস? ঈদ-কোরবানিতে, কালে-ভদ্রে দু’চারজন নগ্ন হলেই দেশজুড়ে সোরগোল হয় অথচ কত কত মজিদ সমাজ-সংসার লুটেপুটে খাচ্ছে, দেশের বারোটা বাজাচ্ছে তাদের নিয়ে তদন্ত পর্যন্ত হয় না। কোন দপ্তরের শরীরে পঁচে গেলে সে দপ্তরের মাথাও ভালো নাই। আর মাথায় যদি ব্যধি হয় সেটা শেকড় পর্যন্ত পৌঁছায়। হলফ করে বলতে পারি, ধর্মীয় আদেশে এই দেশে যারা হঠাৎ দাঁড়ি রেখেছে, ধর্ম-কর্ম শুরু করেছে তাদের খুব অংশই ধর্মকে ভালোবেসে এসব করছে। বরং বেশিরভাগ তার মূল চরিত্র আড়াল করতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। জগতের সব পাপ করতে করতে এরা উপাসনালয়ের দিকে যায়। ঘুষের টাকা পকেটে রেখে, দুর্নীতির অর্থে খাবার খেয়ে অনেকেই লোক দেখাতে সিজদা করে। মসজিদ-মাহফিলের সভাপতি হয়। সমাজ তাদের দানবীর বলে। অথচ আয়ের উৎসের কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে না।
দুর্নীতিবাজদের যা অপরাধ তারচেয়ে কম দায় আমাদের নয়। কোন স্ত্রী তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এতো অর্থ-সম্পদের উৎস কী? সৈয়দ আবেদ আলীদের সন্তানরা একবারও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা, ড্রাইভারি করে এতো গাড়ি বাড়ি কেমনে জুটিয়েছে? অথচ বাবার অবৈধ টাকায় সন্তান মানবতার ফেরিওয়ালা হয়েছে। ভাগ্যের হেরফের না হলে অল্প দিনেই হয়তো উপজেলা চেয়ারম্যানের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেওয়া যেতো! এই সমাজে বাবা তার সন্তানকে জিজ্ঞেস করে না তুমি এতো টাকা কোথায় পাও? সমাজ দুর্নীতিবাজদের এখনো বয়কট করেনি বরং ভালোবেসেছে। রাষ্ট্রও দুর্নীতিবাজদের মাথার ওপরে প্রচ্ছন্ন ছায়ার হাত রেখেছিল। তবে গণমাধ্যমের সংবাদে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জাগরণে দুর্নীতিবাজরা কিছুটা হলেও আতঙ্কিত হয়েছে। তবে সর্ষের মধ্যে যে ভূত তা খুঁজে বের করবে কে? একজন সৎ প্রধানমন্ত্রী একা আর কতদিক সামলাতে পারেন? তবুও দিনরাতের পরিশ্রমে তিনি দেশের হাল শক্তভাবে ধরে রেখেছেন। তবুও নৈতিকতা ও সততা ভূলুন্ঠন করে অনেকেই অনেকভাবে আঙুল ফুলে বটগাছ হচ্ছেন। দু’চারজন যারা এখনো সৎভাবে বাঁচেন তারা অন্যায়ের দৌরাত্ম্যে আলোচনায় আসছে না। তরণ সমাজের কাছে তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য জানতে চাইলে উত্তর কনফিউজড করে দেবে। কোন বৃক্ষের মূল যদি দেশের সেবায় ব্রতী না হয় তবে শাখা-প্রশাখায় তো ভিন্ন-বিভিন্ন দিকেই দুলবে।
দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট ও তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে না পারলে তাদের কালো থাবা থেকে সমাজের নিস্তার নাই। আমার দুর্নীতিবাজ আত্মীয়কে, ঘুষখোর পড়শীকে, অসৎ সহকর্মীকে যেন আচরণে বুঝিয়ে দিতে পারি- আমি তোমাদের ঘৃণা করি। এই সমাজে এখন যা বৈষম্য তা কোনভাবেই থাকতো না যদি দুর্নীতি রুখে দেওয়া যেত। সামান্য একজন ড্রাইভারের যদি অবৈধভাবে এত সম্পদ হয় তবে সে যাদের ছাত্রছায়া পেয়েছে তাদের সম্পদের পরিমান কত? এদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া, অনৈতিক ভাবে উপার্জিত কালো টাকা কিংবা অবৈধভাবে গড়ে তোলা সম্পদ যদি সুষ্ঠুভাবে বন্টন হতো তবে অভাব বলে মানুষের কিছু থাকত না। অন্তত মানুষকে ভিক্ষার জন্য পথে দাঁড়াতে হতো না। শুনতে খারাপ শোনালেও সত্য, বিদেশী সাহায্যের জন্য আমাদের কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার পড়তো না। দুর্নীতি দমনের অস্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে। হাতিয়ার নিজেই যখন প্রলোভনে বিকল হয় তখন সেগুলোকে সম্বল করে যুদ্ধে নামাই বোকামি! পারিবারিক সততা, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা অনেকটাই বিকল এবং ব্যর্থ। ঘুষখোর যে উপাসনালয়ের সভাপতি, দুর্নীতিবাজ যে সমাজের মোড়ল সেখানে শুদ্ধ কর্ম প্রত্যাশিত ফলাফল আনবে- এমন প্রত্যাশ্যাও বেহুদা।
যারা দুর্নীতি করে্ এবং যারা ধার্মিক সেজে দুর্নীতি করে- এই দুই অপরাধ ও অপরাধীর মধ্যে তফাত আছে। যারা মানুষের বিশ্বাস ভাঙে, যারা মানুষকে ঠকাতে মুখোশ ধারণ করে তাদেরকে অবশ্যই গুরুদন্ড দিতে হবে। সৈয়দ আবেদ আলীর ছদ্মবেশ, মতিউরের ন্যায়-উপদেশ প্রকৃত ধর্মচর্চাকারীদের বিব্রত করেছে। শুধু দুর্নীতির অপরাধেরে শাস্তি দিলে এই অপরাধীদেরকে উপযুক্ত শাস্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে। তাদের ভন্ডামির শাস্তি আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়া দরকার। অবৈধভাবে অর্জিত সকল সম্পদের মালিক রাস্ট্র ও ভিক্ষুকগণ হবে। যারা প্রশ্নফাঁসের মত জাতি বিনাশী কর্মকান্ডে জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতিতে জড়িয়ে যারা প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করেছে, পদকে কলুষিত করেছে এবং প্রজাতিকে সন্দেহের কৈফিয়তে দাঁড় করিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে সমাজে নৈরাজ্য মাথাচাড়া দেবে। জাতি হিসেবে অর্জিত সম্মান যেন নষ্ট না হয়, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ যেন পথ না হারায় সেজন্য কঠোরহস্তে দুর্নীতিকে দমন করতে হবে। দুর্নীতি দমন সংশ্লিষ্ট যে সকল প্রতিষ্ঠান সেখানে রাষ্ট্রের পরীক্ষিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। মেরুদন্ড সোজা না থাকলে সামগ্রিকভাবে আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করানো সম্ভব নয়। বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনের জন্য, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের লক্ষ্যে নৈয়ায়িক আদর্শের চর্চা প্রবল করতে হবে। মুখোশধারী-ভন্ডরা যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে, প্রকৃত ধার্মিকরা যাতে বিব্রত না হয়- সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করলে দুর্নীতিকে না বলার শক্তি দ্বিগুন হবে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশর স্বপ্ন দেখি।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন