সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ঘিরে আন্দোলনকারীদের সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণার পর গতকাল শনিবার সারা দেশে সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। এ সময় গাজীপুরের শ্রীপুরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে।
চট্টগ্রামে মন্ত্রী ও মেয়রের বাড়িতে হামলার পাশাপাশি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গুলির ঘটনারও খবর পাওয়া গেছে। সহিংসতার সময় পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এতে শতাধিক নানা শ্রেণির লোক আহত হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
তবে পুলিশের শীর্ষ কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ণ অবস্থানকারীদের বিষয়ে সহনশীলতা প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে।
শ্রীপুরে নিহত ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর আলম (৪৫)। গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মাওনা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের সময় তিনি মারাত্মক আহত হন। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
নিহত জাহাঙ্গীরের বাড়ি সাতক্ষীরায়। তিনি শ্রীপুর উপজেলার মাওনা বকুলতলা এলাকায় ভাড়া থেকে লেপ-তোশকের ব্যবসা করতেন।
শ্রীপুর থানার ওসি আকবর আলী খান দাবি করেন, আন্দোলনকারীদের মধ্যে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে জাহাঙ্গীর মারা যান। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্বৃত্তরা তিনটি পুলিশ বক্স এবং পুলিশের তিনটিসহ সাতটি গাড়ি ভাঙচুর করে। ভাঙচুরের পর তারা তিনটি পুলিশ বক্স এবং পুলিশের তিনটি গাড়িতে আগুন দেয়।
সংঘর্ষের সময় ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে জাহাঙ্গীর আলম তাঁর দোকানে ছিলেন। বিকেল ৩টার পর তিনি আহত হন। শিক্ষার্থীরা উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য মাওনা চৌরাস্তার দিকে নেওয়ার সময় পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে কিভাবে তাঁর মৃত্যু হয়, তা জানা যায়নি।
সন্ধ্যার পর সংবাদকর্মীরা নিহত ব্যক্তির ভাড়া বাসার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে মাওনা-শ্রীপুর আঞ্চলিক সড়কে বিক্ষোভকারীদের লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সংবাদকর্মীদেরও ধাওয়া দেয়।
গত শুক্রবার রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরমের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ এক বার্তায় সারা দেশে ছাত্র-নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদে আজ শনিবার (গতকাল) বিক্ষোভ মিছিল ও আগামীকাল রবিবার (আজ) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল থেকে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।
এরপর বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা দাবি করে আন্দোলনকারীরা। সমাবেশ শেষে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ এলাকায় জড়ো হলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর রাজধানীর মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও গুলির খবর পাওয়া যায়।
চট্টগ্রামে শিক্ষামন্ত্রীর বাসায় হামলা
গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাসভবনে হামলা চালানো হয়। এ সময় বাসার সামনে থাকা দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিকেলে নিউ মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি শেষে মিছিল ২ নম্বর সড়কের দিকে যায়। এ সময় মিছিল থেকে একটি অংশ গিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়।
জানতে চাইলে নগরের পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টার দিকে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
মন্ত্রীর চাচাতো ভাই মেজবাউদ্দিন নোবেল বলেন, অন্তত ২৫০ বিক্ষোভকারী মন্ত্রীর বাসভবনের প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা বাসার সামনে থাকা একটি পাজেরো জিপসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর বৈঠকখানার জানালার কাচ, ফুলের বাগান তছনছ করে। এ সময় মন্ত্রীর মা ও চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন বাসায় ছিলেন।
চট্টগ্রাম মেয়রের বাসায় হামলা-ভাঙচুর
প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের বাসভবনে হামলা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। চসিক মেয়রের এপিএস মো. দুলাল চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘ঘটনার সময়ে মেয়র বাসভবনে ছিলেন। হামলাকারীরা বাইরে থেকে ইটপাটকেল ছুড়ে চলে গেছে। এতে প্রধান ফটকের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেয়র নিরাপদে আছেন।’
বিএনপি নেতাদের বাসায় হামলা-ভাঙচুর
চট্টগ্রামে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ও মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর বাসভবনে হামলা, ব্যাপক ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দফায় দফায় এসব ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে দায়ী করেছেন বিএনপি নেতারা। হামলার সময় নেতাদের কেউ বাসায় ছিলেন না বলে জানা যায়। নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস আলী কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আমার বাসায় হামলা করেছে।’
কুমিল্লায় গুলিবিদ্ধ সাত : দুপুরে কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে হামলা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, নগরীর রেসকোর্স পুলিশ লাইনস এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগসহ দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ হামলা চালান। এতে আহতের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। তাদের মধ্যে অন্তত সাতজন গুলিবিদ্ধ। আহতদের নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বগুড়ায় ভাঙচুর : বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা শহরের সাতমাথা এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর করে।
জামালপুরে সংঘর্ষে আহত ১০ : গতকাল দুপুরে জামালপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় ককটেল বিস্ফোরণ, গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থী, পথচারীসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে।
সিলেটে সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত ২০ : বিকেলে সিলেটে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং ঘণ্টাব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষে সাত পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে।
ফরিদপুরে সংঘর্ষে আহত ১০ : সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১২টায় ফরিদপুর শহরের ভাঙা রাস্তার মোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়।
নোয়াখালীতে আ. লীগ অফিসে আগুন : বিকেলের দিকে নোয়াখালীতে কোটা আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
বরিশালে পুলিশ বক্সে হামলা : বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ লাগোয়া চৌমাথা পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনা ঘটে।
রাজশাহীতে পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর : রাজশাহীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এ সময় নগরীর রেলগেট, তালাইমারী পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায় আন্দোলনরতরা।
স্লোগানে মুখর ছিল রংপুর : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
সিলেটে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিক্ষোভ মিছিলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
শ্রীপুরের হাইওয়ে থানায় হামলা : গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকাল ১১টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তা চলে। এ সময় আন্দোলনকারীরা হাইওয়ে থানা, তিনটি পুলিশ বক্স এবং পুলিশের তিনটিসহ সাতটি গাড়ি ভাঙচুর করে। ব্যাপক ভাঙচুরের পর আন্দোলনকারীরা তিনটি পুলিশ বক্স এবং পুলিশের তিনটি গাড়িতে আগুন দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।
শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
নওগাঁয় সংঘর্ষ, আহত ১০ : নওগাঁয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর করা হয়। সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছে। পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। দুপুর ১২টার দিকে শহরের সরিষাহাটির মোড়ে এসব ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ, পঞ্চগড়ে মহাসড়ক অবরোধ, কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তবে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানকারীদের বিষয়ে সহনশীলতা প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন