পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যাকান্ড পুলিশের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে

নজরুল ইসলাম  ||
দার্শনিক এডমন্ড বার্ক বলেছেন- দুর্নীতি এমন একটি বৃক্ষ যার শাখা-প্রশাখার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা যায় না। আইরিশ লেখক, রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ এবং দার্শনিক এডমন্ড বার্ক এর উক্তি আমাদের জন্য সর্বাঙ্গে সত্য হইয়াছে। কলাম লিখতে গিয়ে ইতিমধ্যে আমার নামের পাশে একটা বদনাম যোগ হয়েছে যা হল আমি প্রায়-ই লম্বা করে ফেলি। আজ সিলেটের রাহহান হত্যাকান্ড, এস আই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, সিলেটের পুলিশ সুপার, পুলিশের সোর্স রহিম ও সামগ্রীক ভাবে পুলিশ প্রসাসন নিয়ে একটু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করবো। পাঠক, কেমন করে আমাদের এত জঞ্জালকে চিকন কথায় প্রকাশ করি? কথা দিচ্ছি চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, প্রথমেই পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে একটু আলোচনা করি। প্রারম্ভেই মনে পড়ে গেল প্রচলিত সেই কথাটি "সবার সাথে হাতা হাতি দারেগার সাথে নয়,

পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য কাজ হচ্ছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কতৃর্ক সকল প্রকার বৈধ পরোয়ানা জারী ও দ্রুত কার্যকরী করা। সমাজের সকল স্তরের শান্তি শৃংখলা রক্ষা। কোন অপরাধ সংগঠিত হতে দেখলে প্রতিরোধ বা নিবারণ করা। সর্বসাধারণের রিরক্তিকর কার্য অর্থাৎ পাবলিক ন্যুইসেন্স নিবারণ করা। অপরাধের বৃত্তান্ত অনুসন্ধান ও তা উৎঘাটন করা। অপরাধীকে বিচারার্থে আদালতে সোপর্দ করা। আইনের ধারাকে অক্ষুন্য রেখে আইনসঙ্গত ভাবে গ্রেফতারযোগ্য সকল অপরাধীকে গ্রেফতার করা।

জনগণের ওপর পুলিশের কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে পুলিশ প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা ফেরায়ে আনা একান্ত প্রয়োজন। গনমাধ্যমে  চোখ বুলালেই লক্ষনীয় যে, সারা দেশে পুলিশ প্রশাসন নিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। জনগণের সেবা দেওয়াই পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য নয় কি? একটি দেশের জন্য সভ্যতা ও সুশাসনের প্রতীক হচ্ছে পুলিশ। বিশ্বে অনেক দেশ আছে যেখানে পুলিশকে রাষ্ট্রের দর্পণ বলা হয়। পুলিশের আচরণের সঙ্গে দেশের সুনাম ও মর্যাদা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শান্তি শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্র চলবে না। যে যত বেশি অপরিহার্য, যার গুরুত্ব ও ক্ষমতা বেশি, তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশ প্রসাসনের ভুমিকা কি গনমাধ্যমে প্রতিনিয়ত এর প্রতিফলন ঘঠছে। দেশে সাধারন মানুষের মধ্যে এখন পুলিশ ভীতি ও পুলিশের ধারা সংগঠিত অপরাধভীতি কাজ করছে যা সিলেটের রায়হান হত্যাকান্ড আমাদের ইঙ্গিত করে। যে কারনেই জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব বেড়েই যাচ্ছে।
 
পাঠক, অন্যায়, আইন ভঙ্গ, দুর্বৃত্ত, দুর্বৃত্তায়ন কম-বেশি দুনিয়ার সব দেশেই আছে। বিচার্য বিষয় হলো পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কতখানি, পুলিশ কতটুকু জনবান্ধব। পুলিশের সাক্ষাতে মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয় ,নাকি মানুষ ভরসা পায়। একটি থানা বা ফাঁড়ি দেশের যে কোন মানুষের নিরাপদ ও ভরসার জায়গা হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ও কিছু লোমহর্ষক ঘটনার কারনে বাস্তবতা ভিন্ন। পাঠক ১৬ কোটির অধিক মানুষের দেশে জনগণের আস্থা ব্যতিরেকে পুলিশের পক্ষে মানুযের প্রত্যাশা পুরন অনেকটা নিষ্ফল আবেদন। সমগ্র দেশে পুলিশ সদস্যের দায়বদ্ধতার চেয়েও বাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দুর্বলতাই প্রকট আকার ধারন করেছে। 

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাইরে পুলিশের যে সব পদে নিয়োগ হয় তার ভিতর ভয়ানক দুর্বলতা চোখে পড়ে। পুলিশের সিপাহি পদে ভর্তি হতে একজনের প্রায় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা গুনতে হয়। এসআই পদের জন্য তা প্রায় পনেরো থেকে ষোল লাখ। আর বদলি প্রক্রিয়ায় তো এলাহি কান্ড। পাঠক, এই টাকা কাদের হাতে যাচ্ছে ?  নিশ্চয়ই তা শুধু পুলিশের ভর্তি কর্তৃপক্ষের পকেটে যাচ্ছে না। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে হতে পারে উপরোক্ত অভিযোগ কতখানি সত্য। পাঠক, যদি তা আংশিক সত্য হয় তাহলে সেটিও পুলিশ প্রশাসনের কার্যকারিতার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেখেন, সিপাহি এসআই পদবির সদস্যরাই স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে, থানায় কাজ করে। তাদের সাথে মানুষের সংশ্লিষ্টতা বেশি। বিরাট অংকের টাকা বিনিয়োগ করার পর যে কোনো ব্যক্তির জন্যই নৈতিক মনোবল নিয়ে কাজ করা প্রায় কঠিন। সুতরাং পুলিশের নিয়োগ পদ্ধতি ও নীতিমালার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা সরকারের যথাযথ মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা সমর্থন এবং সিদ্ধান্ত অতীব জরুরী।

বলছিলাম পুলিশের সোর্স নিয়ে কথা বলবো। পুলিশের সোর্স থাকবে অতি গোপনে। সোর্সের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে সে হয়ে যায় মুল্যহীন। সিলেটের রহিম যদি পুলিশের সোর্স হয়ে থাকেন তাহলে রহিম আর সোর্স হিসাবে কাজ করতে পারবেন না। সোশ্যাল মিডিয়া ও হাই স্ট্রিট অনলাইন HD টিভি গুলো ইতিমধ্যে রহিমকে সেলিব্রটি বানায় ফেলেছে। পুলিশি কাস্টে রায়হান হত্যায় দায় এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই সিলেট পুলিশ সুপারের। একজন পুলিশ সুপারের কাজ হল অধঃস্তন পুলিশ সদস্যদের কল্যাণ, প্রশিক্ষণ, ব্রিফিং, শৃঙ্খলা পদায়নসহ সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন ও তদারকিকরণ। জেলার সকল প্রয়োগসংক্রান্ত কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন ও এ সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় সমন্বয় নির্দেশনা প্রদান এবং তদারকী করণ। প্রশাসনিক বিষয়ে শৃঙ্খলা এবং সংগঠিত দক্ষতা, সাধারণ আদেশ-নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ, বুদ্ধিমত্তা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, পরিদর্শন এবং তত্ত্বাবধায়ন করা এবং এ সংক্রান্তে জারীকৃত আদেশ সমূহ যথাযথ পালন হচ্ছে কিনা তা তদারকি। আমার কাছে মনে হচ্ছে সিলেটের পুলিশ সুপার একই বিষয় বারবার ব্যাখ্যা করে সময় নষ্ট করছেন। রায়হান হত্যার সঠিক বিচার নিশ্চিত করত: এই হত্যার আসামিদের দৃস্টান্তমুলক দণ্ড, সাজা নিশ্চিতে মনোনিবেশ বাঞ্ছনীয় নয় কি?

 কারা আকবরকে ধরছে তা নিয়ে বিতর্ক না করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ হবে যোক্তিক। আকবরকে ধরে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে এটাই মুখ্য বিষয় নয় কি? মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিলেই পুলিশকে কি কথা বলতেই হবে? এই সব হাওয়া টিভি ,খাওয়া টিভি ,কানাইঘাট টিভি, দিরাই টিভি, শাল্লা টিভি ,বাল্লা টিভিতে কথা বলতে বলতে সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ইহা মানুযের বিরক্তির কারন হয়ে দাড়িয়েছে।

প্রশ্ন উকি দিচ্ছে এসআই আকবর কেমন করে এতটা বেসামাল হয়ে উঠলেন? কেমন করে তিনি এমন  বেসামাল হিরো এসআই হয়ে ঊঠলেন? কেমন করে তিনি এ অঞ্ছলের সকল অপরাধের হোতা হয়ে ঊঠলেন? তিনির লাগাম টানার কি কেউ ছিলেন না? সিলেটের পুলিশ প্রসাশনের চেইন অব কমান্ড কাজ করছে কি না এমন প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া যায় ? পুলিশ প্রসাশনের অভ্যন্তরিক অচলাবস্থার কারন উদঘাটন ও এর থেকে উত্তোরন, সিলেটের রায়হান হত্যাকান্ড থেকে কি শিক্ষনীয় তা নিশ্চিতে পুলিশ প্রধানকে কাজ করতে হবে। পুলিশ ফাঁড়িতে সিলেটের রায়হান হত্যাকান্ড এখানে পুলিশের দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। পুলিশের উপর মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা দরকার। 

 পুলিশের কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হচ্ছে থানা। আধুনিক উন্নতমানের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে থানার ভিতরের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা সম্ভব। এখন পুলিশের ধারা সম্পাদিত অপরাধের সিসিটিভি ফুটেজ  যদি ডিলিট করা হয়ে যায় তাহলে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। পুলিশ দিয়ে ভয় দেখানো, মিথ্যা হয়রানি উদ্দ্যেশ্যমুলক মামলায় সাধারন মানুযের দম বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার বিরোদ্ধে মামলা হল তিনি এই ঘঠনার সাথে সম্পৃক্ত নহে। অফিসার ইনচার্জ তদন্ত করে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে মামলাকে কোটে প্রেরন করে আমাদের লোকদের হয়রানি করেই যাচ্ছেন। এসব দেখার কেহ কি আছেন? কেঊ যদি কারো বিরোদ্ধে মিথ্যা হয়রানী মামলা করেন আর সেটা যদি আদালতে মিথ্যা প্রমানিত হয় তাহলে যিনি মামলা করেছেন তাকেই মামলার যাবতীয় খরচ প্রদান করতে হবে এমন আইন সংশোধন চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে মিথ্যা হয়রানিমুলক মামলার সংখ্যা নিচে নেমে আসবে।

 পুলিশ অফিসারদের চেয়ে তাদের আস্কারায় থানার টাউট দালালদের দাপট আরো বেশি। এই সব দালালরা সাধারন জনগনকে জিম্মি করে, ভয় ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করেই যাচ্ছে -যা বন্ধ করা জরুরি। আমাদের পুলিশ প্রসাশন প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতির বিষয়টি এমন যে তার থেকে বের হয়ে নতুনভাবে সময়োপযোগী চিন্তা করতে পারছেন না। খারাপ সংস্কৃতি সংক্রামক ব্যাধির মতো কাজ করে। পুলিশের মধ্যে নৈতিকভাবে সত্ সদস্য আছে। সংখ্যায় তারা স্বল্প হলেও প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির বাইরে এসে তেমন কিছু করতে পারছে না।

 সিলেটের বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আকবর কানাইঘাট বডার সীমান্তে পাকড়াও হওয়ার পর সাধারণ মানুষের প্রশ্নের উত্তরে বলে দিয়েছেন সিলেট পুলিশ প্রসাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরামর্শে তিনি পালিয়েছেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে আসার কথা বলেন। আকবর রিমান্ডে কি বলবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানে পুলিশ সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে বেগ পাচ্ছে সেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুলিশের দ্বারা তদন্তে মানুষ পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না। সিলেটে রায়হান হত্যা মামলায় রায়হানের মায়ের উদ্বেগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  

পাঠক,শেয করতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ প্রত্যাশা করে পুলিশের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষ যথার্থ পদক্ষেপ নেবেন। আমরা জনসাধারণ চাই সৎ ও দায়িত্বশীল পুলিশ। পুলিশের তাবৎ কর্মকর্তা ও সদস্য নাগরিক-প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা ব্রতী ও সচেষ্ট থাকবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

নজরুল ইসলাম 
 জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন