কোন রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী দলকানা মানসিকতায় শাসকদের তেলবাজিতে যখন স্বীয় স্বার্থ হাসিলের পথে হাঁটে তখন সে রাষ্ট্র ঘাটে ঘাটে হোঁচট খায়.......
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। |
সীমাহীন অন্যায় করলে, ক্ষমতার পাশে থেকে দম্ভভরে কথা বললে যে জিল্লাতির জীবন মেলে তা বিচারপতি মানিকের পরিনতি দেখে আন্দাজ করা গেছে বোধহয়। ইতিহাস থেকে ভবিষ্যতের মানুষকে শিক্ষা নিতে হয়। ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের জন্যেও ইতিহাসে লেসন থাকে। মানুষের সাথে আচরণ কেমন হবে, কোন ধরণের কথা বলা সমুচিত নয় কিংবা কোন পরিকল্পনায় সামনে চলতে হবে সেটার প্রেসক্রিপশন বোধহয় পেয়ে গেছি। এই মুল্লুক কোন অসীম শক্তির মালিকের নয় যেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সচল থাকবে। মানুষের শাসনের ভার যখন মানুষ পায় তখন যদি মানুষ মানুষের ওপর সীমালঙ্ঘন করে তবে খোদায়ী গজবের সাথে মাজলুমের যে প্রতিশোধপরায়ণতা যুক্ত হয় তা নির্যাতিতকে মুক্ত করে ছাড়ে। অন্যদিকে নির্যাতনকারীদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
জনতার ভাষা বোঝার সক্ষমতাতেই যেখানে আমার পদ-পদবীর অস্তিত্ব ভর করে সেখানে জালিমের পক্ষ নিলে, মানুষকে জুলুম করলে কিংবা যে সসীম স্বাধীনতা মানুষ ভোগ করে সেটুকুর পথ রোধ করলে কী বিপদ আসে তা জাতির সামনে দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ্য। বীরদর্পে চলতে থাকা, সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে বলতে থাকা এবং যাকে তাকে ধরতে থাকা, হেনস্তা-হয়রানি করতে থাকা একটা পরাশক্তি আপাত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাপারটি তা যদি বিজয়ী এবং বিজেতাকে দরস না দেয় তবে আবার দুর্দিন ঘনাবে। সময়ের পালাবদলে ক্ষমতার অক্ষমতা প্রকাশ করবে। প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগে কোন জনসমষ্টির বুকে কোন বাঁধ চাপিয়ে দিয়ে সত্য বিমুখ রাখা যায় না। হোমরাচোমরাদের ঘিরে থাকা চাটুকার শ্রেণী গুড়ের লোভ ফুরোতেই যেভাবে নিরুদ্দেশে গেছে- এই দৃষ্টান্তে ভবিষ্যত বাংলাদেশের সেবকদের জন্য শিক্ষা আছে।
যদি তারা অন্তর চক্ষু থেকে উপলব্ধি করতে পারে তবে ঘৃণাহীন জীবনের মালিক হতে পারবে। নয়তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সাথে সাথে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াও থমকে যাবে। তখন অসীম শক্তি দেখানো রাজশক্তির ঝান্ডা উঁচিয়ে রাখার মত কান্ডারী অবশিষ্ট থাকবে না। লেজুড়বৃত্তিক যে শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তছরুপের যে সংস্কৃতি কিংবা ব্যক্তির আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার যে নেশা ও পেশা তার খেসারত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই বারবার মেটাতে হবে। হরিলুটের যে স্বভাব তা চেয়ারে বসা মানুষকে ক্ষণে ক্ষণে বদলানোর মত বদলালেও চিরায়ত চরিত্র পাল্টাবে না। জনতার ভাগ্যাকাশে যে চাঁদ উদিত হোক না কেন তাতে দেশের হাল বেহাল দশা কাটাতে পারবে না। সিস্টেম সংস্কার না হলে শাসক বদলিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হবে না। বাংলাদেশের বিবিধ প্রতিষ্ঠানসমূহকে দলীকরণের অপেশাদার ভোগদখলে যেভাবে মেরুদন্ডহীন এবং দলদাস করা হয়েছে তা মেরামত না করে আবার শাসনে ভাসালে স্বপ্নের তরী কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পূর্বেই ডুববে।
কোন রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী দলকানা মানসিকতায় শাসকদের তেলবাজিতে যখন স্বীয় স্বার্থ হাসিলের পথে হাঁটে তখন সে রাষ্ট্র ঘাটে ঘাটে হোঁচট খায়। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছরে তেলবাজ-দখলবাজ শ্রেনীর কবলে পড়ে শাসকগোষ্ঠী সত্য উপলব্ধি করেনি। সত্য তাদের পক্ষেও ছিল না কেননা সত্য যে সহজ-সোজা। চাটুকাররা তাদেরকে যা দেখিয়েছে তারা কেবল তাই দেখেছে, যা শুনিয়েছে তার বাইরেও যে সত্য আছে কিংবা ভিন্ন কিছু ঘটছে তা শুনতে রাজি হয়নি। ইতিহাসে যত শাসকের সম্মানহীন পতন হয়েছে তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাবী আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার কারনে। বড় বড় জুলুম করে শাসকরা তা স্বৈরাচারী প্রোপাগাণ্ডারয় দমন-পীড়নেে বন্ধ করতে পারলেও ঘৃণা কমাতে পারেনি। খাদ্যের দাবীর বিকল্প যে ভোটের দাবি না, উন্নয়নের বিকল্প যে বাকস্বাধীনতা হরণ করা না- রাজশক্তি এই সাধারণ সত্য অনুধাবন করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ফলাফলে, তারা বসে থাকা অবস্থায় চেয়ার চলে গেছে কিংবা স্বপ্ন দেখা অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেছে। নিঠুর বাস্তবতায় নিমজ্জিত হতে বাধ্য হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ কিংবা সমাজ থেকে রাষ্ট্র- এর যেখানেই কোন সদস্যের ক্ষুদ্র অধিকারও হরণ করা হয় তখন ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। গণস্বার্থ বিরোধী কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যখন মুষ্টিমেয় মানুষকে অধিক সুযোগ ও ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়, হয়রানি কিংবা দমন-পীড়ন উম্মুক্ত করা হয় তখন গণবিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রবল শক্তিও খড়কুটোর মত ভেসে যেতে বাধ্য হয়। কাজেই ক্ষমতার ভেতরে থেকে ন্যায়দন্ড সমুন্নত রেখে না চললে বিপদ ঘনীভূত হবেই। যারা কায়দা করে ফায়দা লোটে সেই ধরণের চাটুকারদের থেকে মুক্ত হয়ে রাজকার্য চালাতে ব্যর্থ হলে খেসারত দিতেই হবে; দু'দিন আগে আর পরে। প্রেসসচিব নাইমুল ইসলামরা সত্য দেখে না এবং দেখায় না। লাভ যদি লোভে পরিণত না হতো তবে প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ, কেউকেটা ব্যবসায়ী, দক্ষ আমলা, বিজ্ঞ শিক্ষক কিংবা প্রাজ্ঞ বিচারকদের সুযোগবাদী অংশের এমন লজ্জিত পরিণতি হয়? চেয়ারে থাকার সময় দলদাস নয় বরং মানুষ থাকতে হয়! অথচ আমরা পেশা ছাপিয়ে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠি! নেতা-কর্মীদের ছাপিয়ে ক্ষমতার আরও বেশি তেলবাজি করতে থাকি। কাকে কী বলি, কী শাস্তি দেই আর কেমন আচরণ করি- সেটার হুঁশ থাকে না। সেজন্যই বোধহয় পালাতে গিয়ে মানুষ বেহুঁশ হয়। কলাপাতায় শুয়ে থাকে। আমাদের শিক্ষা হোক। তাতে ভবিষ্যতে ভোগান্তি কমবে। রাষ্ট্রও তড়তড় করে গায়ে-পায়ে বাড়বে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন