বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই ময়মনসিংহের ফুলপুরে ধান বিক্রি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কৃষক সাইফুল ইসলাম (৩৭)। এ নিয়ে ঘটনার এক মাস পর গত ২০ আগস্ট আদালতে মামলা করেন জেলা উত্তর কৃষক দলের সদস্যসচিব শাহ মোহাম্মদ আলী। মামলায় আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। একই মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি নেতা আব্দুল খালেক, আলাল উদ্দিন, আব্দুল মালেক ও ব্যবসায়ী হাজি সেকান্দর আলীকে।
স্বার্থ হাসিল করতে ওই মামলায় বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীদের নাম যুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর গত ২৫ আগস্ট মামলা প্রত্যাহার করেন তিনি। তবে গত ২৭ আগস্ট দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ, উত্তর জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আবুল বাশার আকন্দের নির্দেশে তিনি মামলাটি করেন। একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই রংপুর সিটি করপোরেশনের পথসেতুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ফল বিক্রেতা মিরাজুল ইসলাম মিরাজ।
এ ঘটনায় গত ১৮ আগস্ট রংপুর কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা মামলায় ৬ নম্বর আসামি নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু। তবে ওই দিন ঘটনাস্থলে তিনি দায়িত্বই পালন করেননি বলে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) বগুড়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুকান্ত সাহার আদালতে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন শিবগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল আলিম। অভিযোগ উঠেছে, ওই মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
সামিউল উপজেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ধলু মিয়ার ছেলে। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে তিনি সাবেক বিএনপি নেত্রী বিউটি বেগম, তাঁর স্বামী শাহ আলমসহ দেশের একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীসহ অনেক নিরপরাধ ব্যক্তির নাম মামলায় জুড়ে দিয়েছেন।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় ঢালাওভাবে দায়ের করা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে। তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না এমন নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, চাঁদা না পেয়ে কিংবা ব্যাবসায়িক প্রতিহিংসা অথবা রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতে এসব মামলা করা হচ্ছে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অরাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে হয়রানিমূলক মামলা না করতে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নির্দেশ দিয়েছেন, মামলায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে প্রতিহিংসার শিকার না হন। সর্বশেষ গতকাল রবিবার বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেউ যেন হয়রানিমূলক হামলা-মামলার শিকার না হন সেদিকে খেয়াল রাখতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আবারও আহবান জানান তিনি। এর আগে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারেক রহমান একই আহবান জানিয়েছিলেন। তার পরও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।
রাজনীতি বিশ্লেষক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের আসামি করে ঢালাওভাবে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়েছিল। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর থেকে সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। এসব হয়রানিমূলক মামলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একইভাবে এখনো যদি হয়রানিমূলক মামলা চলতে থাকে, সেটি হবে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি। মামলা করতে হবে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, যাতে কারো প্রতি অবিচার করা না হয়।
সূত্র মতে, গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের ৪২ জেলায় হত্যা ও সহিংসতার ২৫১টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনাকে গণহত্যা, হত্যা ও গুমের ১০৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৪ থেকে গত ২৯ আগস্ট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আটটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তা বন্ধের আহবান জানিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কাছে আমি অনুরোধ করব, শুধু দল নয়, সব মানুষের বিরুদ্ধে ঢালাও যে মামলা দেওয়া হচ্ছে, শত্রুতা থাকলেই যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, এই মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে যাচাই করে নেয়, কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব না। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার। তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলেই নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলায় জড়িয়ে হয়রানি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। গত বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিডিয়া উইংয়ের সমন্বয়ক তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরীর পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী মামলা দায়েরকারীরা প্রকৃত আসামিদের বাইরে যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাধারণ মানুষের নাম আসামির কলামে তালিকাভুক্ত করে মামলা করছে। এভাবে যাচাই-বাছাই না করে গণহারে মামলা করলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গত সরকারের আমলে যারা অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটা জনগণের দাবি। তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। গত ১৫ বছরে তিন ধরনের অপরাধ হয়েছে। এগুলো হলো—মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা (সহস্রাধিক ব্যক্তি খুন হয়েছেন) এবং ফৌজদারি অপরাধ। এ ছাড়াও আর্থিক অপরাধ ও অর্থপাচারের অপরাধ করেছে তারা। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে বিচার করে এসব অপরাধের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।’
যেভাবে মামলাগুলো সাজানো হচ্ছে এতে সত্যিকারের অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে কি না সে ব্যাপারে অনেকের মনেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে। সেই অতীতের সরকারের আমলেও একইভাবে মামলা হতো। একই সঙ্গে মামলাগুলোর সুস্পষ্ট অভিযোগের বিপরীতে অনেককে আসামি করা হচ্ছে। আমার মনে হয় না তারা সঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে। সঠিকভাবে মামলা রুজু করার ব্যাপারে বাদীকে আইনি সহায়তা করা দরকার। এ জন্য ৫০ থেকে ৬০ জন আইনজীবীকে নিয়ে বিশেষ সেল তৈরি করা প্রয়োজন। সেই আইনজীবীরা ভুক্তভোগীদের সহায়তা করবেন। তা না হলে যারা সত্যিকারের দোষী তারা পার পেয়ে যেতে পারে।’
প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি না পেলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে মন্তব্য করে বদিউল আলম মজুমদার আরো বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় মামলা হচ্ছে, এতে সত্যিকার অপরাধীরা শাস্তি না-ও পেতে পারে। এতে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আমি মনে করি, মামলাগুলো সঠিকভাবে সাজানো দরকার। সত্যিকার অর্থে যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। হয়রানিমূলক মামলা কোনোভাবেই সমর্থন করা যাবে না। তাতে যেই লাউ সেই কদুর মতো অবস্থা হবে। এ বিষয়ে আমাদের সাবধান হওয়া দরকার।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির সদস্য নূর খান বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের হত্যার বিচারের দাবিতে যে মামলাগুলো হচ্ছে সেখানে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লুটার সুযোগ খুঁজছে। দুই কোটি টাকা চাঁদা না দেওয়ায় এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অনেকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হচ্ছে। যার সত্যতা নিয়ে এরই মধ্যে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে মামলাকে ব্যবহার করেছে। একইভাবে এখনো যদি ওই ধরনের অবস্থা তৈরি করা হয়, তাহলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে। তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে মামলা করার জন্য রাজনৈতিক দলের কাছে আহবান জানাই। এটা করতে ব্যর্থ হলে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। কারণ মানুষ এখন অনেক বেশি সতর্ক।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা করতে হবে, যাতে কারো প্রতি অবিচার করা না হয়। এখন যেসব মামলা হচ্ছে, তা কতটুকু ফলপ্রসূ, তার যৌক্তিকতা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা যেন ‘মব জাস্টিস’ না হয়ে যায়। যাতে করে এটা মানুষকে হয়রানির পর্যায়ে না যায়।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন