ভারতের মধ্য প্রদেশের তিনটি প্রত্যন্ত গ্রাম কাদিয়া, গুলখেদি এবং হুলখেদি। এই গ্রামগুলো অপরাধী প্রশিক্ষণের কারখানা হিসেবে দেশব্যাপী কুখ্যাতি অর্জন করেছে। গ্রামগুলো শিশুদের চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পরিচিত। পুলিশও এই অঞ্চলে সাবধানে চলাফেরা করে বলে এনডিটিভির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ বা ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের তাদের পিতামাতারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণের জন্য এই গ্রামগুলোতে পাঠায়। প্রথমে অভিভাবকরা গ্যাং নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তাদের সন্তানের জন্য সেরা ‘শিক্ষা’ কোন বিষয়ে হবে তা নির্ধারণ করেন। এই ভয়ংকর পাঠ্যক্রমে নথিভুক্ত হওয়ার জন্য পরিবারগুলো ২ থেকে ৩ লাখ রুপি পর্যন্ত ফি প্রদান করে থাকে।
এখানে শিশুদের বিভিন্ন অপরাধমূলক দক্ষতা শেখানো হয়। যেমন পকেটমার, ভিড়ের জায়গায় ব্যাগ ছিনতাই করা, দ্রুত দৌড়ানো, পুলিশকে এড়িয়ে যাওয়া এবং ধরা পড়লে কিভাবে মারধর সহ্য করতে হয় তা। এক বছর পূর্ণ প্রশিক্ষণ শেষে শিশুটির মা-বাবা গ্যাং লিডারের কাছ থেকে বার্ষিক ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পান।
এই গ্রামগুলো থেকে কিছু ধূর্ত চোরের জন্ম হয়েছে।
যাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সারা ভারতের মধ্যে শিরোনাম হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা আছে।
গত ৮ আগস্ট জয়পুরের একটি বিবাহের অনুষ্ঠান থেকে এক নাবালক চোর ১.৫ কোটি রুপি মূল্যের গয়না এবং নগদ ১ লাখ রুপিসহ একটি ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। জমকালো অনুষ্ঠানে সেদিন অন্ধকার নেমে আসে। অপ্রাপ্তবয়স্ক চোর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যাগটি চুরি করে পালিয়ে যায়।
তবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চুরি করলেও ওই নাবালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যার ফলে পুরো গ্যাংটির বিষয়ে জানা যায়।
আরেকটি ঘটনায় ২৪ বছর বয়সী রবীন্দ্র সিসোদিয়া গুরগাঁওয়ে একটি বিয়েতে গয়নার ব্যাগ চুরি করেছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও যশ সিসোদিয়া নামে ২২ বছর বয়সী এক তরুণ দিল্লিতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গয়নার ব্যাগ চুরি করে পালিয়ে যান। বিভিন্ন রাজ্যে তার বিরুদ্ধে নথিভুক্ত ১৮টি মামলা রয়েছে।
এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলার অতিরিক্ত মহাপরিচালক জয়দীপ প্রসাদ বলেছেন, রাজগড় জেলা অপরাধীদের আশ্রয়ের জন্য পরিচিত, যেখানে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হতে হয়।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি জয়পুরের পুলিশ কমিশনার এই বড় চুরির বিষয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। একটি বিয়েতে প্রায় ১.৫ কোটি রুপি মূল্যের গয়না চুরি হয়েছিল। আমরা জানি যে অপরাধীরা রাজগড়ের ছিল। তাই অবিলম্বে তথ্য সংগ্রহ করি এবং অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে শুরু করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘অপরাধীরা এতটাই দক্ষ যে তারা গহনার মূল্য নির্ধারণ করতে পারে কোনো জুয়েলার্সের কাছে না গিয়েও। তাদের প্রাথমিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিশুদের চুরি, জুয়া খেলা এবং মদ বিক্রির প্রশিক্ষণ দেওয়া।’
অন্য একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এই এলাকায় আইন প্রয়োগকারীরা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন সেই বিষয়ে জানিয়েছেন। বোদা থানার ইন্সপেক্টর রামকুমার ভগত বলেন, ‘এই গ্রামে অভিযুক্তদের ধরতে গেলে আমরা কয়েকটি থানা থেকে বাহিনী নিয়ে যাই। অপরাধীরা ব্যাগ চুরি, ব্যাংক চুরি এবং অন্যান্য অপরাধে উচ্চ প্রশিক্ষিত। প্রায়ই তাদের কার্যকলাপ চালানোর জন্য ১৭ বছরের কম বয়সী নাবালকদের ব্যবহার করা হয়।’
ভগত বলেন, ‘অধিকাংশ চুরি অপ্রাপ্তবয়স্কদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যা এই অপরাধমূলক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা আরো চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।’
কোনো অপরিচিত ব্যক্তি গ্রামে প্রবেশ করলে বাসিন্দারা অবিলম্বে সতর্ক হয়ে যায়। বিশেষ করে হাতে ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন দেখতে পেলে। রাজগড় জেলার পাচোর তহসিলে অবস্থিত এই গ্রামগুলো সারা দেশের পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে।
ভগত এক প্রতিবেদনে বলেছেন, এই গ্রামের ৩০০টিরও বেশি শিশু বিভিন্ন রাজ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে চুরির সঙ্গে জড়িত। এই গ্যাং অত্যন্ত সংগঠিত। অপরাধ করার আগে সব বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় তারা।
গ্রামের ধনী ব্যক্তিরাও বিডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১-২ বছরের জন্য দরিদ্র শিশুদের ভাড়া করে, যা ২০ লাখ রুপি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। একবার প্রশিক্ষিত হলে এই শিশুরা প্রায়ই বিনিয়োগের পাঁচ থেকে ছয় গুণ উপার্জন করে এবং এরপর গ্যাং থেকে মুক্তি পায়। এখানে শিশুরা সাধারণত স্বল্প শিক্ষিত এবং দরিদ্র পরিবারের। কিন্তু তাদের বিত্তশালীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়, ফলে সহজেই যেকোনো অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারে।
এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাত্রা ব্যাপক। গ্রামগুলোর ২ হাজারের বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে সারা দেশের থানায় ৮ হাজারের বেশি মামলা নথিভুক্ত রয়েছে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন