দুলাভাইয়ের ঘুষে দোলনের স্বর্ণবাণিজ্য

সরকারি চাকরিকে কাঁচা টাকা কামাইয়ের হাতিয়ার বানিয়ে দুুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বনখেকো মোশাররফ হোসেন। দেশের সোনা চোরাকারবারের অন্যতম হোতা এনামুল হক খানের ভগ্নিপতি সাবেক এই প্রধান বন সংরক্ষক নিজেকে রীতিমতো অবৈধ আয়ের মেশিনে পরিণত করেছিলেন। দেশসেবার পবিত্র দায়িত্ব ভুলে গিয়ে সরকারি চাকরিকে নিজের বাড়ি, গাড়ি, জমি, প্লট, ফ্ল্যাট আর ধন-দৌলতের পাহাড় গড়ার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর ওই ধন-সম্পদে মুড়িয়ে নিজের স্ত্রীকে রাজরানির আদলে বানিয়েছেন কোটিপতি ব্যবসায়ী আর শ্যালক এনামুল হক খানের সোনার ব্যবসায় দিয়েছেন মোটা টাকার পুঁজি।

 

এনামুল হক খান ওই টাকায় সোনা চোরাচালানের নায়ক সেজে নিজে ফুলেফেঁপে হয়েছেন কলাগাছ। এই শক্তিতে নিজেকে তৈরি করেছেন অপরাধজগতের মাফিয়া হিসেবে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, প্রধান বন সংরক্ষক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে মোশাররফ হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়।

 

অবসরে যাওয়ার পর তিনি ‘মেঘনা বিল্ডার্স’ গঠন করে আবাসন ব্যবসায় নামেন। আর তিনি দুর্নীতির দায় থেকে নিজেকে আড়াল করতে বেশির ভাগ সম্পদই দিয়েছেন স্ত্রী পারভীন সুলতানাকে। একটি বড় অংশ বিনিয়োগ করেছেন শ্যালক দোলনের সোনার ব্যবসায়।

সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোশাররফ এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।

 

তাঁদের ১১২ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র আরো জানায়, মোশাররফের অবৈধ টাকায় স্ত্রী পারভীন সুলতানার নামে ধানমণ্ডির ১১ নম্বর রোডে অজান্তা অ্যাপার্টমেন্টে চার কোটি টাকা মূল্যের দুই হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে মেমোরো ভিলায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের চার হাজার ৮২০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটির বি ব্লকে ১০ কোটি টাকা মূল্যের বহুতল বাড়ি, মানিকগঞ্জের রাখোরা মৌজায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ২০ বিঘা জমি, ঢাকার বাড্ডার সাঁতারকূল মৌজায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের আট বিঘা জমি, রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির লেভেল-১, ব্লক সিতে চার কোটি টাকা মূল্যের ৪০০ বর্গফুটের দোকান, রাজধানীর ৫৩ বায়তুল মোকাররমে ১০ কোটি টাকার ৩০০ বর্গফুটের দোকান, কক্সবাজারের টেকনাফে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ তিন বিঘা জমি, কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকতের কাছে ১০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ এক বিঘা জমি এবং চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ১০ কোটি টাকা মূল্যের ছয় কাঠা জমি রয়েছে।

এ ছাড়া মোশাররফের নামে আছে ঢাকার ধানমণ্ডির ১৬ নম্বর রোডে (পুরনো-২৭) ১৬ নম্বর প্লটে জেনেটিক প্লাজার চতুর্থ তলায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের তিন হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটেই তিনি বাস করেন। তাঁর নামে ঢাকার চন্দ্রিমা সুপারমার্কেটে দুই কোটি টাকা মূল্যের ৩০০ বর্গফুটের দোকান, ঢাকার পূর্বাচলে ২০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১০ কাঠা জমি, বাগেরহাটের গোপালকাঠি গ্রামে ২০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাপনাসহ ১০ কাঠা জমি।

 

এ ছাড়া বিভিন্নজনকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে এক কোটি টাকা। মোশাররফের মেয়ে মোহনা থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে পাঁচ কোটি টাকায় তাঁর নামে কেনা হয়েছে একটি ফ্ল্যাট।

মোশাররফের টাকায় এনামুল সোনা চোরাচালানের হোতা

এদিকে দেশে সোনা চোরাচালানের হোতা এবং হত্যা মামলার আসামি এনামুল হক খান দোলনের বিরুদ্ধেও স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রবাসীসহ একাধিক ব্যক্তির জমি দখল করে মৎস্য খামার করার অভিযোগ রয়েছে। এনামুল হক খান দোলনের আপন চাচা সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দিন খান। দোলনের আপন চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মনোহরদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু। তাঁর ভাতিজা মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও কাঁচিকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন খান কনক। তাঁদের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দলীয় প্রভাবে এনামুল হক খান দোলন মনোহরদীর কাঁচিকাটা ইউনিয়নের খারাব গ্রামে গড়ে তুলেছেন রাজকীয় বাংলো। সেটা করতে একাধিক নিরীহ অসহায় কৃষকের ফসলি জমি দখলে নিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে এক প্রবাসীর জমি দখল করে মৎস্য খামার করারও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় অধিবাসী রাশিদুল ইসলাম তাওহীদ বলেন, ‘আমাদের জমি দখল করে দোলন সাহেব মৎস্য খামারের ভেতরে নিয়ে গেছেন। এই জমি আমরা বিক্রি করি নাই। জোর করে দখলে নিয়ে গেছেন।’

স্থানীয় অধিবাসী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী মুঠোফোনে বলেন, ‘লুলু খানের ছেলে এনামুল হক খান দোলন স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে মৎস্য খামার করেছেন। কিছু বললেই পুলিশ প্রশাসনের ভয় দেখায়।’ 

মনোহরদী উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি কাজী শরিফুল ইসলাম শাকিল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা চোরাকারবারি এনামুল হক খান জীবনের শুরুতে স্থানীয় শেখেরবাজারে পাতিল বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় বাস কাউন্টারে টিকিট বিক্রি শুরু করেন। এরপর তিনি বর্তমান স্ত্রীর বাসায় কেয়ারটেকারের কাজ নিয়ে বাসার মালিক আমেরিকাপ্রবাসীর স্ত্রীকে (বর্তমান স্ত্রী) কৌশলে হাত করে বাড়ি-গাড়ি লিখিয়ে নেন। পরে ডিভোর্স করিয়ে আজান নামের এক ছেলেসন্তানসহ দোলন নিজেই তাঁকে বিয়ে করেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘দোলন নিরীহ অসহায় মানুষের জমি দখল করে বিশাল বাংলো বানিয়েছেন। তাঁর কালো টাকা সাদা করার জন্য কৃষি খামার করেছেন। এ ছাড়া দোলন তাঁর ভগ্নিপতি সাবেক বন সংরক্ষক মোশাররফ হোসেনের অবৈধ টাকাও ব্যবসায় খাটিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।’

নজরদারিতে সোনা চোরাচালানের হোতা দোলন

ডায়মন্ড অ্যান্ড ডিভার্স ও শারমিন জুয়েলার্সের আড়ালে এনামুল হক খান দোলন সোনাপাচার সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। হত্যা মামলার আসামি দোলনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পরও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁর বিরুদ্ধে সোনা চোরাকারবারের তথ্য দিয়েছে দুবাই ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। নজরদারিতে রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। বর্তমানে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যেও উল্টো তিনি শুল্ক গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসছেন সোনা। বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে সোনা পাচার করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। শুল্ক গোয়েন্দারা মাঝেমধ্যে চোরাচালানের সোনা জব্দ করছেন। বাহকদের তুলে দিচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে। মামলা করা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু চোরাচালানের হোতা এনামুল হক খান অধরাই থেকে যাচ্ছেন।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এনামুল হক খান দোলন দুবাই ও সিঙ্গাপুর সিন্ডিকেটের সহায়তায় দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে সোনা ও স্বর্ণালংকার দেশে পাঠান এবং তা বিক্রি করে বিদেশে অর্থ পাচার করেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুবাইভিত্তিক সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছে দুবাইয়ের অর্থপাচার প্রতিরোধ ইউনিট।

একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেটের জুয়েলারি দোকানকে কেন্দ্র করে দোলন অবৈধ স্বর্ণালংকার ব্যবসার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। ঢাকায় একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট ছাড়াও তাঁর ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের অর্থ রয়েছে। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদীর কাঁচিকাটা ইউনিয়নের খারাব গ্রামে এনামুল হক দোলনের বিশাল বাংলো। পাঁচতারা মানের অভিজাত বাংলোটি খানবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই বাড়ি নির্মাণের জন্য যাবতীয় ফিটিংসহ গৃহসজ্জার উপকরণ আনা হয় দুবাই ও ইতালি থেকে।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন