সততার ভিন্নরকম শক্তি আছে! 

পতনের যে রেশ দুনিয়ায় শুরু হবে তার শেষমাথা নরকে। কারো অভিশাপ নিয়ে, কারো চোখের জলের কারন হয়ে মুক্তির আশা

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক। 

ক্ষমতার চাদরে থেকে কিংবা কালো হাতের আদর পেয়ে লোভের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের পরিণতি কত ভয়ানক হতে পারে তা যারা ধৃত হয়েছে কিংবা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের অসহায়ত্ব দেখে অনুধাবন করা উচিত। অন্যায়ভাবে রাজকীয় সুযোগ নিয়ে যারা রাজা-বাদশাহীর জীবন কাটিয়েছে, ভোগে মত্ত থেকেছে কিংবা অকারণে ক্ষমতা দেখিয়েছে তাদের কেউ চিরকাল টিকেছে? টেকার কথা নয়। কারো অধিকার কেড়ে নিয়ে, কাউকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে কিংবা ক্ষমতার বড়াইেয় গণমানুষের সাধারণ ইচ্ছা উপেক্ষা করে পৃথীবিতে কারো শক্তি চিরস্থায়ী হয়নি। দুর্নীতিবাজ আমলা, ঘুষখোর পুলিশ, নীতিহীন শিক্ষক কিংবা অসৎ উদ্দেশ্যের মানুষ- দেশ এই শ্রেণীর কাছে কখনো কখনো জিম্মি হয়েছে কিন্তু এরা দেশ জয় করতে পারেনি। মানুষ এদেরকে ক্ষণিকের জন্য ভয় পেয়েছে কিন্তু সম্মান করেনি। অসৎ লোকেরা তাদের চরিত্র উম্মোচিত হওয়ার ভয়ে তর্জন-গর্জন করে। মানুষের কণ্ঠরোধ করে সত্য দমিয়ে রাখতে চায়, উচ্চকণ্ঠী হয়ে ন্যায়কে পরাভূত করতে চায়। অথচ সত্য নিজে নিজেই শক্তিশালী। সে প্রকৃতির ইচ্ছায় প্রকাশিত হয়। আপন আলোয় সবাইকে ঋদ্ধ রাখে। 

অসৎ ক্ষমতা, অন্যায্য হস্তক্ষেপ এবং দম্ভ-অহং মানুষের পতনকে ত্বরান্বিত করে। দুর্বলকে ঠকানোর সময়, কারো অধিকার দখল করার সময় কিংবা কাউকে পেষণ করার কালে অপরাধীরা ভাবে সে কোন ক্ষত কিংবা ছাপ রেখে যায়নি। অথচ প্রমাণ রয়ে যায়। যে কর্তা পরের জন্য গর্ত খুড়েছে অনুরূপ গর্ত তার লাইফ সার্কেলে তাকেও সামনে আনবে এবং কৈফিয়ত চাইবে। যারা ক্ষমতা দেখিয়ে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য রচনা করেছে, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যোগ্যদের অধিকার হরণ করেছে কিংবা লুটপাটের মাধ্যমে দেশের মরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে তারাও প্রত্যেক অপরাধ কিংবা পাপের জন্য কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। কেউ যদি ভেবে থাকে মানসিক অস্বস্তি, পারিবারিক অশান্তি কিংবা সামাজিক ঘৃণা শাস্তি নয়- তবে ভুল হচ্ছে। আইনের দন্ড কিংবা ঘোরতর অসম্মানের চেয়ে অবিশ্বাসে বাঁচা কিংবা অসম্মানে থাকা- এসব শাস্তির প্রাথমিক স্তর হলেও অশান্তির তীব্র অনল সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। অন্যায় করে টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটানো, সন্তান বিপথে যাওয়া কিংবা সমাজে অসম্মানিত হওয়ায় যে মানসিক সংকট তৈরি হয় সেটাকে অবজ্ঞা করার আদৌ সুযোগ নাই। 

 

 অথচ একজন সৎ মানুষ সহজ-সরল জীবনযাপন করেও কত সুন্দরভাবে সসম্মানে বাঁচে। তাদের বুকের সাহস কখনো ফুরোয় না। শরীরের পোশাক সস্তা হলেও সততায় বাঁচা মানুষদের আদর্শ কখনো এমন সস্তা হয় না। সে নিজেকে পরের কাছে, ভয়ের কাছে কিংবা অন্যায়ের কাছে বেচে না! দূরের মানুষ কিংবা অচেনা মানুষও যখন সৎ মানুষ সম্পর্কে কথা বলে তখন সম্মানে হৃদয় বিগলিত হয় এবং মস্তক নত হয়ে আসে। আপন হতেই শ্রদ্ধা-সম্মানের জন্ম হয়। যে মানুষ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে না, কাউকে ঠকায় না, দুর্নীতিতে জড়ায় না কিংবা রাষ্ট্রের স্বার্থ বিক্রি করে দেয় না- সে আদর্শবান নিজ গুণেই মুল্যবান। এমন আত্মশক্তির স্বতঃমূল্য আছে। সারাদিন পরিশ্রম করে, সামান্য আয়োজনের ডাল-ভাত খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে পারার যে তৃপ্তি তা অসৎ মানুষের স্বপ্নের মত অথচ সততায় জীবন-যাপনকারীদের কাছে এটা নৈমিত্তিক রুটিন। সততার যে শক্তি, সৎ লোকের যে সুগন্ধি তাতে সমাজ-সংসার আলোকিত হয়। সমাজে যারা সৎভাবে বাঁচে অসুস্থ সমাজ সাময়িক সময়ের জন্য তাদের ভ্রকুটি করে, তাচ্ছিল্য ভরে অপদস্থ করতে চায় অথচ সততা ও সত্যবাদী সর্বদা জয়ী হয়। এই যে এই সমাজের টিকে থাকা, সম্মানে সামনে চলা তা কতিপয় সৎ মানুষের অস্তিত্ববান থাকার কারণেই সম্ভব হচ্ছে। নয়তো কবেই মানব সভ্যতার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটতো- তা আন্দাজ করাও যাচ্ছে না। 

 

কোন সমাজ যখন কলুষিত হয় তখন কর্মজীবীর বেতনের চেয়ে আয়কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, শিক্ষক তাঁর ব্রত ভুলে যায় এবং সেবক চড়ামূল্যে তাঁর সেবা বিক্রি করতে শুরু করে। যখন দুর্নীতিবাজের জীবনযাপনের আভিজাত্যের সাথে তুল্য করে সৎ মানুষকে লেলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় তখন তীব্র স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা প্রতিবাদ করে, যারা নীতি আদর্শ নিয়ে বাঁচে কিংবা যারা নিজের স্বার্থের চেয়ে পরের যৌক্তিক স্বার্থকে অধিক প্রাধান্য দেয় তারা জীবদ্দশাতে হারে না। কখনো কখনো বাধাপ্রাপ্ত হলেও নীতিবানের তরী ডোবে না। তুফান মোকাবেলা করে সে শির উঁচিয়ে জীবনের জয়োধ্বনি শোনায় এবং জয়োৎসব করে। সে মানুষ তত সুন্দর যারা ম্যোরাল ডিগনিটি যত সম্মৃদ্ধ। মানুষের ঘৃণায় যারা বাঁচে আর যারা মানুষের সম্মান পেয়েছে- তাদের দু’জনের কাছে জীবনের অর্থ দু’রকম। ভোগ মানুষকে মহৎ করে না বরং বিবেকের ভাবনায় স্থুলতা আনে। যে জীবনের দুর্গন্ধ শুঁকেছে তার কাছে সুন্দরের সুগন্ধি অসহ্য ঠেকবে। অথচ যে আলোকের সন্ধান পেয়েছে সে লোভনীয় আঁধারে জীবন জড়াবে না।  পঁচবে না এবং দুর্গন্ধ ছড়াবে না। 

 

অল্পায়ুর জীবটাতে যেন মানুষের ঘৃণা না চাপে। বাঁচার জন্য কত সম্পদ লাগে? কত ক্ষমতার তেজ সহ্য করা যায়? যারা মানুষকে কথা কিংবা কাজের দ্বারা দুঃখ দেয়, তারা সুখে থাকবে? সে সুখ অধরা, আশা অবান্তর। সততার ভিন্ন রকম শক্তি আছে। সুশোভিত শৃঙ্খলা আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত সম্মান, নামের সাথে জড়িয়ে যাওয়া শ্রদ্ধা কিংবা কাগজের পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে যাওয়া সম্মানের জন্য এক জীবন সংগ্রাম করে তবেই সেটা অর্জন করতে হয়। সম্পদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, তবে যে সম্পদ মানুষকে লোভী বানায়, দম্ভ-অহংকারের চূড়ায় চড়ায় এবং আকাশ থেকে ধূলায় নিক্ষেপ করে- সে শঙ্কার পথ এড়িয়ে চলা যৌক্তিক। বিনত থাকা মানে পরাজয় নয়।  পাপের রশি প্রত্যেককে ছাড় দেয় কিন্তু পাপ কাউকে ছেড়ে দেয় না। কর্মের অন্যায়, কথার অন্যায় কিংবা ইচ্ছার অন্যায় যেটুকু, সেটুকুর কুফল ভোগ করে তবেই মুক্তি পেতে হবে। সবকিছুর ফয়সালা দুনিয়াতে হবে না বটে তবে পারলৌকিক আলোতে কিছুই অস্বচ্ছ থাকবে না। পতনের যে রেশ দুনিয়ায় শুরু হবে তার শেষমাথা নরকে। কারো অভিশাপ নিয়ে, কারো চোখের জলের কারন হয়ে মুক্তির আশা? যার অধিকার খোওয়া গেছে তার ভক্তিতে না আসতে পারলে মোক্ষ মিলবে না। বরং দুঃখ বেড়েই চলবে। 

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন