ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট প্রত্যাশার জায়গাটি হারিয়েছে
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।|
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশি। বাংলাদেশের দীর্ঘতম সীমান্ত সংযোগ ভারতের সাথে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাথে ভারত ধীরে ধীরে রীতি-আচরণে প্রভূ হয়ে ওঠে। দুর্বল প্রতিবেশিকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, ব্যবসায়িক নীতি-নৈতিকতা ভঙ্গ করে সতর্কতা ছাড়া আমদানি বন্ধ রাখা, সীমান্ত হত্যা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া এমনকি কোন দল বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় সরকার গঠন করবে তার নীতি নির্ধারণ করতেও ভারত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত শালীনতাহীন নগ্ন ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে অঙ্গরাজ্যের মত সুযোগ আদায় করা, অসময়ে নোটিশবিহীন বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা চাপিয়ে দেওয়া, মোটকথা বাংলাদেশকে ভারত নির্ভর রাখতে যত ধরণের কূটকৌশল প্রয়োজন- সেসবের সব আয়োজন ভারত সেরেছে। ফলাফলে বন্ধুপ্রতীম ভারতের সাথে ইতিহাসের সবচেয়ে তিক্ত বৈরিতা বাংলাদেশের সাধারণ জনসাধারণের মনে দানা বেঁধেছে। ধেয়ে এসেছে সন্দেহ। এমনকি পতিত সরকারের সাথে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সখ্যতার সময়েও ভারত বয়কট দাবী প্রবল আকার ধারণ করেছিল। ভারতীয় পণ্য বর্জন, ভারতে চিকিৎসা গ্রহনের হার কমে আসা, সেদেশে ঘুরতে যাওয়ার সংখ্যা তলানিতে নামা এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সেখানে কেনাকাটা করতে যাওয়ার মানসিকতা হৃাস পাওয়ার নজির বিগত কয়েক বছর জুড়েই ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-মনোভাবকে পাত্তা না দেওয়া, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা, মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা তুঙ্গে রাখা এবং ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা পদদলিত করায় ভারত প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অথচ সময়ের পালাবদলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক অনন্য পর্যায়ের উচ্চতায় পৌঁছার দরকার ছিল। ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধুরতা ছিল। প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যাপারে যে মনোভাব ও সম্মানের দৃষ্টি বজায় থাকার উচিত ছিল তা এনডিএ জোট সরকার ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেবল বাংলাদেশের বিগত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে এবং নিজেদের প্রতিবেশি অসুলভ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। অথচ তিন মেয়াদের শাসনে পতিত সরকার অনেককাংশেই জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির পথে হেঁটেছে। ভারত সেটা বিবেচনায় না নিয়ে বরং মদদ দিয়েছে। অথচ ভারত যদি বিগত সরকারের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হতো তবে ফ্যাসিস্ট মনোভাব তৈরি করতে বাধা দিত। অন্যদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে আংশিক সত্য এবং অধিক গুজব প্রোপাগান্ডা চলমান ছিল সেটা যাচাই-বাছাইহীনভাবে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার চরমভাবে লালন করেছে। ফলাফলে বাংলাদেশের জনগণের সাথে ভারতীয় সরকারের দূরত্ব স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরাসহ সমগ্র ভারতের শান্তিকামী, মানবিক, উদারচিন্তার, গণতন্ত্রমনা ও সচেতন ভারতীয়রা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবলোকন করছে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে দ্বি-পাক্ষীয় সম্পর্ক কিছুটা শিথিল অথচ তিক্ত হয়েছে। এতে কার্যত ভারত ত্রিশঙ্কু দশায় পতিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেউ কেউ এমনকিছু মন্তব্য করছে যা স্বাভাবিক সম্পর্ককেও আরও অবনতির দিকে ধাবিত করবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অন্যতম উদীয়মান পরাশক্তি। তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ আশা করছে। অন্যদিকে প্রতিবেশি চীন, পাকিস্তান এমনকি নেপাল, ভূটানের মত ছোট্ট দেশের সাথেও বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কালাপানি ও ডোকালামের দ্বন্দ্ব তিক্ততা বাড়াচ্ছে। এর মাঝে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে আক্রমন কিংবা দৃশ্যমান পর্যায়ের কোন ক্ষতিকর পদক্ষেপ গ্রহন করলে সেটা ভারতকেই বিপদে ফেলবে। ইতোমধ্যে সেভেন সিস্টার্সে উত্তেজনা চলছে। সামনেই হরিয়ানা ও কাশ্মীরে নির্বাচন। সুতরাং ক্ষমতাসীন বিজেপী-জোটের ভোটে আঘাত আসতে দেওয়া উচিত হবে না।
গুজরাটের রায়ট, বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ, গোংমাস রান্নার অপরাধে মুসলিম পরিবারকে নির্যাতন এবং হত্যাসহ বিবিধ কারণে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট প্রত্যাশার জায়গাটি হারিয়েছে। তিস্তার ন্যায্য পানি না দেওয়া, বাংলাদেশের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা, রোহিঙ্গা প্রত্যার্পণ ইস্যূতে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট না দিয়ে বিরত থাকা এমনকি চীনের বাংলাদেশে উন্নয়ন অংশীদার হওয়াকে অপছন্দ করা- এসব ভারতবিরোধী মনোভাবকে ত্বরান্বিত করেছে। ভারত বাংলাদেশের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশিসুলভ আচরণ করেনি বরং প্রভূত্ব কায়েম করতে চেয়েছে। ভারত সবসময় এমন সরকারকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে যারা ভারতের ন্যায়-অন্যায় চাওয়া/দাবি অবলীলায় পূর্ণ করবে। শক্তিশালী প্রতিবেশি হিসেবে এ চাওয়াকে চাণক্যের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী অন্যায্য বলা চলে না অথচ যে প্রজন্মের কাছে বিশ্ব ইতিহাস স্পষ্ট, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যায়নীতি ও স্বাধিকারের অকাট্য প্রমাণ বিদ্যমান তাদের থেকে অন্ধ আনুগত্য আশা করা বৌদ্ধিক দাবি হবে না। বাংলাদেশি তরুণ-যুবকরা আবরারের জীবন উৎসর্গের ত্যাগ দেখেছে. ফেলানীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলতে দেখেছে কিংবা ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে উঠতি ফসল ভেসে যেতে দেখেছে। কাজেই সকল হিসাব-নিকাশ উপেক্ষা করে ভারত যদি কোন বিতর্কিত ইস্যূ আমলে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আক্রমন করার মত ভুলও করে তবে তা শোধহীন যাবে না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ন্যায্যতার ভিত্তিতে হোক। সংখ্যালঘু নির্যাতনের গুজবে যে ভারত প্রীত হয় সেই ভারতের তাদের নিজের দেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারেও সজাগ ও সচেতন থাকা উচিত। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রী জয়ন্ত কুমার সিংহ কিংবা স্বর্ণা দাসের হত্যাকান্ড বাংলাদেশীদেরকে ব্যথিত করে এবং সীমান্তে সুন্দর সম্পর্কের খাতিরেই এসব বন্ধ করা আবশ্যক। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে যে দেশটির নাম ও অবদান সবচেয়ে বেশি জড়িত সেই দেশের সাথে এমন ছন্দহীন সম্পর্ক কাম্য নয়। ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া। তেমনি বাংলাদেশেরও উচিত তারা নিকটতম প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। শত্রুতায় কখনোই একপাক্ষিক ক্ষতি হয় না।
বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, বন্দী প্রত্যার্পণ চুক্তি কিংবা গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের অনন্য উল্লেখযোগ্য নজির। সশস্ত্র বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিমযের মাধ্যমে দু’দেশই লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার সুবিধা, আকাশসীমা এবং রেলযোগাযোগ ব্যবহার এবং করিডোর সুবিধা ভারতেকে প্রভূত উপকার করছে। ট্রানজিট সুবিধা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোর সাথে অন্যান্য রাজ্যগুলোর দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। পরিবহন ব্যয় কমিয়েছে। সময় সাশ্রয় করছে। দু’দেশের মধ্যকার সংস্কৃতির বিনিময়, সাহিত্য বাজার সৃষ্টি এবং শিক্ষায় সক্ষমতা বিনিময় সিদ্ধান্তে দু’পক্ষই লাভবান। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সাথে বাংলাদেশীদের ভাষাগত একতা এবং সৌহার্দ্য দীর্ঘদিনের। ভারতের বনেদী রাজনীতিবিদ, বিখ্যাত শিল্পী-কুশলীদের অনেকেরই আদি নিবাস বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল যেভাবে ভারতবাসীর সন্তান-সম্পদ তেমনি বাংলাদেশীদের জন্যও গর্বের জায়গা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত গীত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। অথচ ভারত বাংলাদেশের দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। অতিরঞ্জিত ভারত প্রীতি এবং অহেতুক ভারত ভীতি দু’দেশের মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। প্রতিবেশি দুর্বল হলেও তার সাথে সদাচার করা সবলের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যদিকে ছোটদের উচিত বড়দের সম্মান নিশ্চিত রাখা। কূটনৈতিক সম্পর্কে নতজানু মনোভাব কিংবা উগ্রতা নয় বরং ন্যায্যতার ভিত্তিতেই আচরণের মানদন্ড নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিযোগিতামুলক উম্মুক্ত পৃথিবীতে কাছের প্রতিবেশির সাথে যদি শত্রুতা থাকে তবে দূরের শত্রু উদ্দেশ্য সাধনে সহজেই সফল হয়। ভারত-বাংলাদেশের বিভেদ দূর হোক। দলের স্বার্থে নয় বরং দেশের স্বার্থে সম্পর্ক বজায় থাকুক। যৌথ সম্পর্কের সেতুতে কাউকে পশ্চাতে রেখে কেউ উন্নতির শিখরে আরোহন করতে পারে না। বন্ধুপ্রতীম সম্পর্কের রেশ সমান্তরালে চললে তবেই দু’পক্ষের স্বার্থ রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল ছাড়া ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাথে যদি ভিন্ন কোনো দেশের খেলা হয় তখন এদেশের অধিকাংশ দর্শক ভারতের ক্রিকেট সমর্থন করে। শচীন-সৌরভদের ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা বাংলাদেশেও অল্প নয় বরং গল্প করার মতই। আইপিএলের সময় ভারতের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির সমর্থনে বাংলাদেশের মহল্লায় মহল্লায় উৎসব হয়, ভারতীয় নাটক-সিনেমার বিপুল দর্শক ও বাজার বাংলাদেশ। বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ক্ষেত্র। কাজেই ভ্রাতৃপ্রতীম ভারতের সাথে বাংলাদেশের শত্রুতা নয় বরং গভীর বন্ধুত্বই কাম্য। ক্ষমতার পালাবদল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কেউ সব ভালোকাজ করেও চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না আবার কেউ স্বৈরাচার হয়েও জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। জনগণের রূচি পরিবর্তন হয়। কিছুদিন একদল থাকবে আবার অন্যদল ক্ষমতায় আসবে। এতে ভারসাম্য রক্ষা পায় এবং দুর্নীতি কমে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কারা অধিষ্ঠিত হবে তা বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক নির্ধারিত হবে। ভারত যদি এখানে হস্তক্ষেপ করে, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে ষড়যন্ত্র চালায় তবে তা আকাঙ্ক্ষিত ও গ্রহনযোগ্য হবে না। কোন দল বিশেষের সাথে নয় বরং চৌকষ কূটনৈতিক সম্পর্ক দেশের সাথে হওয়া উচিত। কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে বন্ধুত্ব নয় বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হবে দু’দেশের মধ্যে। নিরবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের দেশ, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সুপার পাওয়ার, বিশ্বের অন্যতম জাতিরাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ তথা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে- এটা বাংলাদেশের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার । তবে সেই ভাগ্য সৌভাগ্যে পূর্ণ হবে সমতায়। ভারত চলবে ন্যায্যতায়- এই দৃষ্টিভঙ্গি অচিরেই সৃষ্টি হোক। নয়তো দুর্বল ঘাসেও ভাঙনের শুরু করিয়ে দিতে পারে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন