আমি সেই আশাবাদীদের দলে যারা স্বপ্নে দেখে, নারী একদিন সমগ্র বিশ্ব দেখার সুযোগ পাবে--
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। |
যে সমাজে একটি ধলা ছেলের সাথে একটি কালো মেয়ের বিয়ে হলে সমাজস্থরা মেয়েটিকে ভাগ্যবতী বলতে শুরু করে সেই সমাজ ও সমাজপতিদের নিয়ে আপাতত আশার কিছু দেখছি না। উঠতি বয়সের ছেলেরা এমন একটু-আধটু লটরপটর করতেই পারে আর ওসব বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে- এইসব বলে বলে যারা ছেলেদের সব পাপ মাফ করার সাফাই গায় তাদেরকে নিয়ে আমার আলোচনার ইচ্ছাও নাই। নারীকে সব সময় বাঁকা চোখে দেখতে হবে, নারীর শরীরের বর্ণ তার মর্যাদা নির্ধারণ করবে আর নারীর শিক্ষিত হওয়া সমাজ মানতেই পারবে না- এমন সমাজের নেতাদের বিরুদ্ধে আপতত আমার অভিযোগ নাই। যে সমাজ মানুষের হতে চেষ্টা করেনি সেই সমাজের সাথে বিবাদে জড়ালে আপাতত আমি জিতবো না।
নারী সারাজীবন রেঁধেই যাবে, নারীর ভাগ্যে কেবল কান্নাই থাকবে- নারীর সেই ভাগ্য আমি আমার মা-বোন-স্ত্রী'র পর্যন্ত মানলেও আমার কন্যাও সেই নিয়তি বরণ করবে?- মানবো না। এখানে এসে বিদ্রোহ করেও ফল পাবো কি-না বুঝতেছি না তবে মায়ের অবহেলায় যদি প্রতিবাদ করতাম, স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান যদি দিতে পারতাম তবে এই সমাজ একটু হলেও বদলাতো। যে সমাজ পায়ে পায়ে নারীদের দোষ ধরে, নারীর স্বাবলম্বিতাকে কটাক্ষ করে কাটানো হয় কিংবা পুরুষের জাত থেকে কেবল গুণ খোঁজে- সেই সমাজে আমি মায়ের যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারিনি। মৌলবিদের আওয়াজের বিষয়বস্তুতে নারীর জন্য কেবল জাহান্নাম, সিনেমাতে যে নারী কেবল পণ্য কিংবা আমোদ-প্রমোদের বাহন, সে নারী আমারও যে বোন তা রসিয়ে রসিয়ে ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় ভুলে যাই। ঘরে নারীকে দমাতে পারলে, তার মত দেওয়া থামাতে পারলে নিজেকে সুপুরুষ ভাবতে শুরু করি। অথচ কবেই যে কাপুরুষ হয়ে গেছি- সমাজ তা আমায় ধরিয়ে দেয়নি। একদিনও শোধরাতে বলেনি।
নারী পুরুষের যে দূরত্ব, নারীতে-পুরুষে যে বিভাজন তা নবীরা সৃষ্টি করেনি তবে ধনীরা করেছে। মাংসপেশি শক্তিতে নিজেকে প্রভু হিসেবে ঘোষণার সময় বিবেক প্রতিরোধ করেনি! নারী মানে দাসী, সন্তান জন্মদানের কলসী- এভাবেই নারীকে দেখতে দেখতে তাকে প্রয়োজনের কালে কেবল প্রেয়সী ডেকেই থেমে যাই। সাহিত্যে-সমাজে নারীকে কেবল দেহের জন্য মূল্য দেওয় হয়েছে অথচ পুরুষের মত একটা মন যে নারীর শরীরের ভেতরেও থাকে তা কখনোই জানতে যাওয়া হয়নি। সেই মনেরও যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে, রুচি-পছন্দ থাকে কিংবা ঘৃণা-অভিমানের অধিকারও পোষে তা বিবেচ্য হয়নি। নারী ঘরে কতঘন্টা খাটে, রান্নায় কতক্ষন ব্যস্ত থাকে এবং কখন আসবে খাঁটে- এই সাফল্যেই নারীকে সমাজ মূল্যায়ণ করছে। অতীতের অন্ধকার সময়গুলো থেকে নারীর প্রতি বর্বরতা কিছু কমেছে বটে তবে অন্ধকার এখনো কেটে যায়নি। নারীকে ঘিরে এখনও কথিত শিক্ষিতের যা দৃষ্টিভঙ্গি তাতে বর্বরতাও আছে বটে।
নারী একজন বিশ্বস্ত পুরুষ আকাঙ্ক্ষা করতে পারে কি-না তা ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তার সম্পদ, রূপ-যৌবনের প্রতিরূপে নারীর সম্মান সমাজ সাব্যস্ত করে। চামড়ার চাকচিক্যে যে প্রজাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের নিয়ে মন খুলে কতখানি আলোচনার স্পেস সমাজ দেবে- তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। নারী অধিকারে বিশ্বাসীদেরকে সমাজ বারবার বয়কট করেছে। নারী ছাড় দেবে, নারী মানিয়ে নেবে কিংবা নারী অঝোরে কাঁদবে কিন্তু শব্দ করতে পারবে না- এসব শেখাতে শেখাতেই মেয়েগুলোকে বালিকা করে বড় করা হয়। নারী সবার পরে খাবে, নারী থাকলে খাবে কিংবা নারীরাই পরিবারের সবার খেয়াল রাখবে, যত্ন করবে- এসব সমাজ খুব যত্ন করে শিখিয়ে দেয়। অথচ নারীরও যে যত্ন লাগে তা কতজনে বোঝে? পতি প্রভূ- কখনোই এ নীতির ব্যত্যয় হলে সমাজ দোররা উৎসব করে। কথা দিয়ে নারীর বুক ক্ষতবিক্ষত করা হয়। নারীর অধিকার রক্ষার জন্য এই যুগেও আইন আদালত লাগে।
ছোটবেলা থেকে যে নারীকে মা মা ডাকতে ডাকতে বড় হয়েছি সেই মা যে সমাজে কত দূর্বল, তাঁর অবস্থান যে কত নাজুক- তা নিয়ে একদিনও দরবার করিনি। বরং নারীকে লাজুক সাজিয়ে তাঁর চুপ থাকাকে সম্মতি ধরা হয়েছে। নারীর অধিকারের রচনা পড়তে হয়েছে কিন্তু কখনোই পুরুষের অধিকার বিষয় রচনা লিখতে হয়নি। সমাজে পুরুষের অধিকার ছেলে হয়ে জন্ম গ্রহনের মুহুর্ত থেকেই আছে। পুরুষের সমান সংখ্যক হয়েও নারীর অবদান ইতিহাসে অল্পই! কালে কালে নারীকে চৌকাঠ পেরুতে দেওয়া হয়নি। স্বামীর ঘরে নারীর জীবন রান্না ঘরেই অধিক কেটেছে। নারীকে শেখানো হয়েছে, যে যা বলে চুপ করে সহ্য করবে! যে নারী সামান্যতম প্রতিবাদ করেছে তাকে বলা হয়েছে বেহায়া-বেশ্যা! পুরুষের ভাগ্য ভালো, আমাদের মা এবং ঝিয়েরা বেহায়া হওয়ার দলে যোগ দেয়নি! নয়তো যে অন্যায় নারীর সাথে যুগান্তর জুড়ে হচ্ছে তাতে অনেক পুরুষের কল্লার কল্পনা করে যেতো না।
আমি সেই আশাবাদীদের দলে যারা স্বপ্নে দেখে, নারী একদিন সমগ্র বিশ্ব দেখার সুযোগ পাবে। নারীকে ভাগ্যবতী বলার জন্য সেদিন কালো-ধলা দিয়ে বিচার করা হবে না। যেদিন নারী-পুরুষ মিলেমিশে সমাজটাকে ভাঙবে এবং নতুন কর গড়বে সেদিন নারীর ইচ্ছাও মানুষের ইচ্ছা হবে। সন্তান জন্ম দিয়ে থেমে যাবে নারী, নারী চিরকাল কেবল কারো ওপর নির্ভরশীল থাকবে কিংবা নারী হবে পুরুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যম- এমন চিন্তার বদল
ঘটবে। নারীও মতামত দেবে, তার কথার মূল্য হবে এবং যৌক্তিক দাবি পূরণ হবে- নারী-পুরুষের সমতার বিশ্ব গড়ার শুরু ঘর থেকে আরম্ভ হোক। ছেলে সন্তান জন্ম নিলে ভিন্নরকম খুশি হওয়ার প্রথার যেদিন বদল হবে সেদিন এই সমাজের সাথে আমার দ্বন্দ্ব ঘুচে যাবে। রূপ-রঙ নয়, লিঙ্গ-দেহের বল নয় বরং নারী ও পুরুষ যেদিন একে অন্যের পুরোপুরি সম্পূরক হয়ে উঠবে সেদিন যে সমাজ গড়ে উঠবে- সেই সমাজ আজন্মের প্রত্যাশায়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন