যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। কোয়াড (চতুর্দেশীয় অক্ষের) সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন, একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
মোদির মার্কিন সফরের কর্মসূচিতে একাধিক অনুষ্ঠান ছিল। ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্কে বসবাসরত ভারতীয় কমিউনিটির সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেলাওয়ারে তার বাসভবনে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনেক প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকর্ম ভারতকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ‘কোয়াড লিডার’দের (চতুর্দেশীয় অক্ষের শীর্ষস্থানীয়) সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন মোদি। জাতিসংঘে ‘বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের’ প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কথা বলেছেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন মোদি।
অন্যদিকে মোদির সফরের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করবেন।
যদিও এই সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন?
যা বলেছিলেন ট্রাম্প
মোদি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছনোর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তার সঙ্গে দেখা করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা এই সাক্ষাতের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সেই সময় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিসরি জানিয়েছিলেন, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ট্রাম্প ও মোদির সাক্ষাতের বিষয়টি ‘নিশ্চিত’ বা ‘অস্বীকার’ কোনোটিই করেননি পররাষ্ট্রসচিব।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদির যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় কমিউনিটির সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটি বা লং আইল্যান্ডে দেখা করার যে কর্মসূচি ছিল, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প পৌঁছতে পারেন বলে তীব্র জল্পনা ছিল। যদিও তা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ট্রাম্পকে হিউস্টনের ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই কর্মসূচিতে ভারতীয় কমিউনিটির বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হয়। আবার ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। তাকে স্বাগত জানাতে আহমেদাবাদে এক লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী একে অন্যকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে এসেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন তাদের সাক্ষাৎ হলো না, বিশেষ করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প এ কথা বলেছিলেন?
ট্রাম্প প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদির তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার সিদ্ধান্তকে ‘কৌশলগত পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. মুক্তাদার খান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী আবহে মোদি যদি ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তার নির্বাচনী প্রচারকে সমর্থন করতেন বা তাদের এই সাক্ষাৎকে ট্রাম্পের সমর্থন হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তা ‘নির্বুদ্ধিতা’ হবে।
কেন সাক্ষাৎ হলো না?
আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক স্বস্তি রাওয়ের মতে, যদি দেখা করা হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস—দুজনের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে হতো। যেকোনো একজনের সঙ্গে দেখা করাটা কূটনৈতিক দিক থেকে ‘সঠিক হতো না’।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রবীন্দর সচদেবও মনে করেন, ভারত বা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশ ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করতে পারে না। তিনি ব্যাখ্যা করেন, নরেন্দ্র মোদি যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতেও চাইতেন, তাহলেও তা সম্ভব হতো না। তিনি শুধু ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতেন না, কমলা হ্যারিসের সঙ্গেও দেখা করতেন। দুই নেতার সঙ্গে বৈঠক নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব হয়নি। হয়তো সেই কারণেই ট্রাম্প ও মোদির সাক্ষাৎ হয়নি।
তার পরও প্রশ্ন রয়ে যায়, কেন সাক্ষাতের কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন ট্রাম্প? সচদেব বলছেন, ‘এমনও হতে পারে, ভারতীয় কূটনীতিকরা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস—দুজনের সঙ্গেই বৈঠকের জন্য ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই হয়তো ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তিনি মোদির সঙ্গে দেখা করবেন। যদিও সেই সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি।’
ড. মুক্তাদার খান অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে একবারই বলেছিলেন, তিনি মোদির সঙ্গে দেখা করবেন, যদিও এই বৈঠক নির্ধারিত ছিল না।
তবে এই সাক্ষাৎ বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়কে প্রধানমন্ত্রী মোদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘উপেক্ষা’ করেছেন বা তার থেকে নিজেকে ‘দূরে সরিয়ে রেখেছেন’—এমন বলাটা সঠিক হবে না। বরং বিষয়টা অনেকটা এমন, দুই নেতার দেখা হওয়ার জন্য পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বর্তমান আবহে ঠিক ছিল না।
মার্কিন নির্বাচন
আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে চলেছে। রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে আবারও মাঠে নামছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রার্থী হলেন কমলা হ্যারিস। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের প্রচার এখন তুঙ্গে। বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে প্রতিযোগিতা বেশ কঠিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনী লড়াই থেকে কিছুদিন আগে সরে দাঁড়িয়েছেন। দুই মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে।
ড. মুক্তাদার খান বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে ঠিক হয়ে যাবে কে এই নির্বাচন জিতবেন। এই পরিস্থিতিতে মোদি যদি ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন এবং কোনো কারণে তিনি কমলা হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করতে না পারেন, তাহলে তা মোদির জন্য ভালো হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, কমলা হ্যারিস হয়তো নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি। আর কমলা হ্যারিস দেখা করতে অস্বীকার করায় মোদির টিম হয়তো ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে দিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি বলেছিলেন, ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’। যদিও তা হয়নি। পরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাট সরকারের সঙ্গে সম্পর্ককে সঠিক দিশায় আনতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ভারতকে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরাও মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপদেষ্টারা হয়তো তাকে পরামর্শ দিয়েছেন, এই মুহূর্তে মার্কিন নির্বাচনের আবহে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা কোনো একজন প্রার্থীর সঙ্গে দেখা করা ঠিক হবে না।
চীনের উত্থান
বিশ্লেষকরা এ-ও মনে করেন, বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ভারতের জন্য ‘কূটনৈতিক ও কৌশলগত’ প্রয়োজন। অধ্যাপক মুক্তাদার খান বলছেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক মজবুতের পেছনে রয়েছে চীনের উত্থান। যতক্ষণ চীনের আগ্রাসনের নীতি বজায় থাকবে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করে রাখাটা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এই প্রসঙ্গে অন্য একটা উল্লেখযোগ্য দিকও তুলে ধরেছেন মুক্তাদার খান। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, শিল্প ক্ষেত্রে আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে চীন। তারা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে, কম্পানিগুলোকে ভর্তুকিও দিচ্ছে। যতক্ষণ অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে, ততক্ষণ ভারতও কিন্তু তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক রাও মনে করেন, রাশিয়া যদি চীনের দিকে আরো ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে মজবুত করাটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন