মার্কিন কূটনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি হবে?

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্য ১০টি দেশ ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। এই প্রস্তাবের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ঘোষণাকে ‘যুগান্তকারী’ বলে বর্ণনা করেছেন। গভীর রাতে যে ‘জুম ব্রিফিংয়ে’ গণমাধ্যমকে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে, সেখানে সাংবাদিকদের উপস্থিতির সংখ্যা এতটাই ছিল যে কয়েকজন সাংবাদিককে ফিরিয়েও দিতে হয়েছে।

 

এখন ‘যুগান্তকারী’ বলতে বাইডেনের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, বর্তমানে ভয়াবহ যুদ্ধের আবহে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ও আরবদেশগুলোর কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্মতি পাওয়ার বিষয়কে তারা একটা বড় ‘কূটনৈতিক সাফল্য’ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বিশ্বশক্তিগুলো যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, সেটি ঠিক সেই অর্থে যুদ্ধবিরতি নয়।


 

বিবৃতিতে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ দুই পক্ষকেই ২১ দিনের ‘যুদ্ধবিরতির’ মাধ্যমে লড়াই বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে মধ্যস্থতার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটা ‘জায়গা তৈরি করা যায়’। এরপর জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজল্যুশন ১৭০১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি কূটনৈতিক বন্দোবস্তের জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছে, যেমনটা ২০০৬ সালের ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে গৃহীত হয়েছিল।

যদিও তা কখনোই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। গাজার ‘থমকে’ থাকা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে সমঝোতা নিয়েও এখানে বলা হয়েছে।

 

তিন সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির বাইরে, আঞ্চলিক লক্ষ্য যা অধরা থেকে গিয়েছে তা পূরণের জন্যও প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু বিষয়ও আছে, যা  দুই দশক ধরে কূটনীতিকদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।

 


 

জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে নিউইয়র্কে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। তাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সম্মতিক্রমে ইসরায়েল-লেবানন সংকট নিয়ে বয়ান জারি করার সুযোগ পেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। যা একদিক থেকে ‘সুবিধাজনক’ হয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্বশক্তিগুলোর যুদ্ধবিরতি আহ্বানের বিষয়ে সম্মতি অর্জন করার ক্ষেত্রে ‘সাফল্যের’ অর্থ এই নয় যে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফেলেছে।

দেখে মনে হচ্ছিল যেন মার্কিন কর্মকর্তারা (যুদ্ধবিরতি নিয়ে) দুই পক্ষের অবস্থান বাস্তবের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে রয়েছে—এমনটা উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন।

যেন ‘পাবলিক মোমেন্টাম’ (জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা) তৈরি করার এবং দুই পক্ষের (ইসরায়েল ও লেবানন) ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন তারা।

 

কিন্তু ইসরায়েল ও লেবাননের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি? এর উত্তরে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এটুকু বলতে পারি, আমরা দুই পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনার ভিত্তিতে এই সময়টাকেই এই আহ্বান (যুদ্ধবিরতির বিষয়ে) জানানোর জন্য সঠিক সময় বলে মনে হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবের বিষয়ে তারা জানে। এই বিষয়ে কী করবে সে নিয়ে বলার জন্য আমরা আগামী কয়েক ঘণ্টা তাদের দিচ্ছি।’


 

এখন প্রশ্ন হলো, এর অর্থ কি ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ এই বিষয়ে রাজি হয়েছে? এই প্রশ্নটা আরো একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো রকম যোগাযোগ নেই। সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্পষ্ট জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েল ও লেবানন সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে গভীর আলোচনা করা হয়েছে। যার অর্থ হলো লেবাননের সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই হিজবুল্লাহর কর্মকর্তাদের যোগাযোগ করা হয়ে থাকবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের আশা, যখন লেবানন সরকার ও ইসরায়েল সরকার—দুই পক্ষই এই প্রস্তাব মেনে নেবে, তখন দুই পক্ষের পক্ষ থেকেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।’

এই মুহূর্ত পর্যন্ত কথাগুলো বেশ ‘আশাব্যঞ্জক’ শোনাচ্ছিল। কিন্তু গভীর রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ের পর কূটনীতিকরা বৈরুতসহ লেবাননে আরো কয়েকটা জায়গায় ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পান। একই সঙ্গে ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকটা রকেট হামলারও খবর এসে পৌঁছয়।

গৃহযুদ্ধের পর লেবানন সবচেয়ে বেশি রক্তপাত দেখেছে চলতি সপ্তাহে। লেবাননের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ছয় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ জন শিশুও আছে।

যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা এবার কার্যকর হতে পারে?
শুক্রবার জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যাওয়ার জন্য নিউইয়র্কের উদ্দেশে বিমানযাত্রার আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় একটা প্রতিবাদী বিবৃতি জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত কোনো কিছুতে রাজি হননি। শুধু তা-ই নয়, ওই বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে ‘পূর্ণ শক্তি’ দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।


 

অন্যদিকে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষরের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অসত্য’। তাই বলা যেতে পারে, এই যৌথ বিবৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর ওপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের পিছু হটাতে ও থামানোর জন্য একটা ‘বেসলাইন অবস্থান’ তৈরি করে।

যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্যে কাজ এখন চলবে। চলতি সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে নিউইয়র্কে এই বিষয়ে আরো কাজ করা হবে এবং তার পরও তা অব্যাহত থাকবে বলেই অনুমান করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই আলোচনায় ফরাসিদের পাশাপাশি নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু তাদের বয়ানে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’ করার মতো শব্দ ব্যবহার করেছে।

গত বছর ৭ অক্টোবরের পর গাজায় জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এই জাতীয় যুদ্ধবিরতির আহ্বানসংক্রান্ত প্রস্তাব কয়েক মাস ধরে ‘সক্রিয়ভাবে আটকে’ রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটা ততক্ষণ চলেছে, যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘অপ্রত্যাশিতভাবে’ শব্দটি ব্যবহার করেন এবং মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। তার পর থেকে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে চলা নিবিড় কূটনীতি কিন্তু ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির চুক্তিতে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে।

এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এখন হামাস ও ইসরায়েলকে দায়ী করছে। তাদের যুক্তি, দুই পক্ষের ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার’ অভাব রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টিও অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহকে চাপ দিয়ে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করাতে পারবে—এ বিষয়ে খুব একটা আস্থা তৈরি হয় না।

যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে স্থলভাগে লড়াই, ইসরায়েলের বিমান হামলার তীব্রতা এবং গত সপ্তাহে পেজার বিস্ফোরণের মাধ্যমে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা অব্যাহত থাকার মতো ঘটনাবলি দুই পক্ষের সংঘাতকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।

প্রসঙ্গত, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে গাজার যুদ্ধবিরতির পার্থক্য রয়েছে। ইসরায়েল ও লেবাননের চুক্তির ক্ষেত্রে জিম্মিবিষয়ক আলোচনা জড়িত নয়, যা গাজা চুক্তির বিষয়ে অচলাবস্থার অন্যতম একটা কারণ ছিল। তবে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির ইস্যুতে প্রত্যেক পক্ষের উদ্দেশ্য এখনো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরায়েল চায় উত্তরাঞ্চল থেকে ৬০ হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষকে ফিরিয়ে আনতে এবং লেবাননের ওপর দৈনিক রকেট হামলা বন্ধ করে ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে। আবার হিজবুল্লাহ চাইছে ইসরায়েল লেবাননে হামলা বন্ধ করুক। সেখানেও দক্ষিণাঞ্চলে ৯০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এই শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ওই দেশে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। দক্ষিণে উপস্থিতি বজায় রাখাও তাদের লক্ষ্য। তারা চায় না গত সপ্তাহের রক্তাক্ত ঘটনাগুলো লেবাননের ভঙ্গুর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাঝে তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভকে জাগিয়ে তুলুক। ইসরায়েল-লেবানন সংকট সমাধানের দায়িত্বে থাকা ওয়াশিংটনের দূত আমোস হোচস্টেইনের কাছে অবশ্য দুই পক্ষের মাঝে সমঝোতার বিষয়টা অধরাই থেকে গিয়েছে। আর এখানেই মার্কিন নেতৃত্বাধীনের এই ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ আকাঙ্ক্ষাটা ‘জটিল’ হয়ে ওঠে।

যৌথ বিবৃতিতে পৌঁছনোর আলোচনা সম্পর্কে বিবিসির জাতিসংঘে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সংবাদদাতা টম বেটম্যানের উপলব্ধি হলো, ওয়াশিংটন ২১ দিনের এই যুদ্ধবিরতিকে আসলে ‘দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের’ জন্য আলোচনার জায়গা প্রস্তুত করার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যকে নিশ্চিত করতে চাপও বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সমঝোতা আলোচনার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজল্যুশন ১৭০১ বাস্তবায়ন করতে গেলে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর ওপর একাধিক শর্ত আরোপ হবে। এর মধ্যে রয়েছে লিতানি নদীর দক্ষিণে লেবাননের একটা খণ্ড থেকে হিজবুল্লাহের পশ্চাদপসরণ ও দীর্ঘমেয়াদে ওই গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণ।

২০০৬ সাল থেকে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে ১৭০১ সালের এই রেজল্যুশন ভঙ্গের অভিযোগ করে আসছে। এই পুরো বিষয়টার অর্থ হলো, দুই দশক ধরে যে লক্ষ্য পূরণ করা কূটনীতিকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তা এখন লেবানন-ইসরায়েলে মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে একটা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন উভয় পক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কারণে দুই দিকেই রক্তপাত অব্যাহত তখন এই ‘বর্তমান কূটনীতি’ বোধ হয় একটু বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলছে।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন