জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ এবং সেখানে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্ভাবনার বার্তাই দিয়েছে। এই মূল্যায়ন দেশের রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিও দেশের নিরাপত্তা প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি ‘অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা’ বলে কারো মূল্যয়ন।
এ ছাড়া বলা হচ্ছে, তিনি তাঁর ভাষণে ফ্যাসিবাদের চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তা সবার কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আবার কারো মতে, তিনি তাঁর ভাষণে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যাসহ ভারতের মোদি সরকারের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি। দেশের স্বার্থে এসব বিষয় বিশ্বসম্প্রদায়ের নজরে আনা দরকার ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ করেননি তিনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান মনে করেন, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া বাংলাদেশের নতুন যাত্রার অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। তাঁর মূল্যায়নে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়াং ইর সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক দেশের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
গত বুধবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক করেন। প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, সোলার প্যানেল প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ এবং ব্যাবসায়িক সহযোগিতা সম্প্রসারণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেন তাঁরা।
তার আগের দিন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একটি ইভেন্টের সাইডলাইনে এই দুই নেতা কথা বলেন। তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে করমর্দন করেন।
অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান বলেন, ‘জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি সুবক্তা।
তাঁর এই ভাষণ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনাও হয়েছে। তবে এই অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে তিনি যেসব বৈঠক করেছেন তার মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি আমি দেশের নিরাপত্তা প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি। এটা চীনের আগ্রহের কারণেই হয়েছে বলে আমার মনে হয়। চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। এতে দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাদের নিরাপত্তা সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে।
এটি অবশ্যই ড. ইউনূস ও বাংলাদেশের অর্জন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটিও ছিল আমাদের সামরিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটা এক ধরনের অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতায় আমাদের পুরনো শাসকরা আবার ফিরে আসার যে পাঁয়তারা করছেন, তারা এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে। ড. ইউনূস দেশের স্বার্থে অতীতের বৈরিতা ভুলে সবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের এ ধরনের যে একটি সাহসী উদ্যোগ নেবেন তা আমাদের প্রতিবেশী দেশ চিন্তাও করতে পারেনি।’
নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জাতিসংঘে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ ছিল অসাধারণ। তিনি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের বীরত্বগাথা তুলে ধরেছেন। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নানা সমস্যা-সংকট নিয়েও কথা বলেছেন। উনি অসাধারণ বক্তা। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। তাঁর সঙ্গে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রথার বাইরে গিয়ে বিরল বৈঠক করেছেন এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর সাম্প্রতিক নিয়োগে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এ ছাড়া অধিবেশনের ফাঁকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার সঙ্গে বৈঠক করেছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। সেই সঙ্গে নিউইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের অসীম সাহসী তরুণ প্রজন্মের কথা যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়। এসব বৈঠকে তিনি তাঁদের কাছ থেকে নিজ সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এসবই আমাদের প্রাপ্তি। এ ছাড়া ৮৪ বছরের একজন মানুষ এত পরিশ্রম করতে পারেন, এত প্রাণবন্ত, উদ্যমী থাকতে পারেন তা অকল্পনীয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কথা যেভাবে তুলে ধরেছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ফ্যাসিবাদের চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা সবার কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর উপস্থাপনার মাধ্যমে বিশ্বদরবার জানতে পারল হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন জনগণের কাছে কতটা দুঃসহনীয় ছিল। অবশ্য ফ্যাসিবাদের পতনের জন্য ছাত্রদের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলের অবদানের কথা বললে তা আরো সুন্দর হতো।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নাম ঘোষণার পর সবাই যেভাবে করতালির মাধ্যমে ড. ইউনূসকে অভিবাদন জানালেন তাতে স্পষ্ট যে গণতন্ত্রকামী বিশ্ব তাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাঁর সংক্ষিপ্ত সফরে বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোসহ বিশ্বনেতারা যেভাবে তাঁকে উষ্ণ অভিবাদন জানিয়েছেন, সেটিও বিরল।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ওই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন, তাঁর সরকারের অগ্রাধিকার সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক উত্তরণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ করেননি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে এ ব্যাপারে তিনি একটা ধারণা দিতে পারতেন।
গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে তিনি তাঁর সরকারের অবস্থান নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর ভাষণে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যাসহ ভারতের মোদি সরকারের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি। দেশের স্বার্থে এসব বিষয় বিশ্বসম্প্রদায়ের নজরে আনা দরকার ছিল।
তিনি আরো বলেন, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার কথা তিনি বক্তৃতায় উল্লেখ করলেও দেশের অর্থ-সম্পদ অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়া ও ধনী-গরিবের অবিশ্বাস্য ফারাক এবং শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে তেমন কিছু উল্লেখ নেই।
বেকারত্ব দূরীকরণ ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসা সম্প্রসারণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অথচ এই ব্যাপারে দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশেষ কিছু জানে না। তা ছাড়া বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য নির্মূলে তাঁর এই তত্ত্বের কার্যকারিতা সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসবের পরও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ ব্যতিক্রমী তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর ভাষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্ভাবনার বার্তাই দিয়েছে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন