হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে বলে ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি হামলার মূল পরিকল্পনারী তাকেই বলা হয়। ওই হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস। এর পরেই ইসরায়েল গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে।
হামাসের ওই নজিরবিহীন আক্রমণের ফলে সৃষ্ট যুদ্ধের শুরুতেই সিনওয়ার অদৃশ্য হয়ে যান। সিনওয়ারকে হত্যা করার ঘটনাটি বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। কারণ ড্রোন, ইলেকট্রনিক ইভড্রপিং ডিভাইস এবং মানব তথ্যদাতাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েও হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা তার অবস্থান শনাক্ত করতে পারছিল না।
ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘কমান্ডার ইয়াহিয়া সিনওয়ার ... এবং তিনি একজন মৃত ব্যক্তি।
’
৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত। সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ- ২২ বছরেরও বেশি সময় ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন।
কারাগারে থাকার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবার কিছু সময় সম্পূর্ণ নির্জন কারাবাস ছিল, যা তাকে আরো উগ্রপন্থী করে তোলে বলে মনে করা হয়।
তার বাবা-মা ফিলিস্তিনের আশকেলনে বসবাস করতেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ‘আল-নাকবা (বিপর্যয়)’ যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পৈতৃক বাড়ি ইসরায়েলিরা দখল করার পর উদ্বাস্তু হয়েছিলেন।
সিনওয়ার খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। তারপর গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সিনওয়ার ১৯৮২ সালে ১৯ বছর বয়সে ‘ইসলামপন্থী’ হওয়ায় ইসরায়েল তাকে প্রথম গ্রেপ্তার করে এবং এরপর ১৯৮৫ সালে আবার গ্রেপ্তার হন।
এই সময়েই তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেছিলেন।
তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেছেন, “দুইজন ‘খুব, খুব ঘনিষ্ঠ’ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছর পর তিনি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল-মাজদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স মাত্র ২৫ বছর ছিল।”
আল-মাজদ তথাকথিত নৈতিকতা অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিত। ‘যৌন ভিডিও’ রাখছে এমন দোকানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছিল। সেই সঙ্গে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করছে এমন সন্দেহভাজন কাউকে পেলে হত্যা করত। ১৯৮৮ সালে সিনওয়ার দুই ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। একই বছর তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যার জন্য ইসরায়েল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
ধারণা করা করা হচ্ছিল, সিনওয়ার গত বছরের বেশির ভাগ সময় মাটির নিচে সুড়ঙ্গে কাটিয়েছেন। গাজায় দেহরক্ষীদের সঙ্গে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি খুব কম লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। অবস্থান শনাক্ত হতে পারে এই ভয়ে তিনি মানুষের সঙ্গে কম যোগাযোগ করতেন। মানব ঢাল হিসেবে ইসরায়েলি জিম্মিদের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবেন বলেও আশঙ্কা ছিল।
কিন্তু তাকে যেদিন ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করে, সেদিন তার সঙ্গে কোনো জিম্মি ছিল না। দেখা মেলেনি তাদের দেহরক্ষীদেরও। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আইডিএফ। তার মৃত্যুর পর আঙুলের ছাপ এবং দাঁতের নমুনা ব্যবহার করে তার দেহ শনাক্ত করা হয়। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার তার মৃত্যুর ঘোষণা দেয় ইসরায়েল।
ইসরায়েল ইতিমধ্যেই গাজায় হামাসের আরো অনেক জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে হত্যা করেছে। যাদেরকে ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ‘মৃত মানুষ’ হিসেবে বেঁচে আছেন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের নেতা মোহাম্মদ দেইফ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি জুলাই মাসে গাজায় বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বলে আইডিএফ জানিয়েছে।
হামাস গত জুলাই মাসে তেহরানে তাদের সামগ্রিক নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করেছে। পলাতক থাকা সত্ত্বেও এর পরের মাসে সিনওয়ারকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন