ধারদেনা করে নির্বাচন করা পলক হাতান হাজার হাজার কোটি টাকা

কারাবন্দি সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী এবং নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর ১৮ শতাংশ ভিটাজমি, এক বিঘা ধানি জমি, নগদ ১০ হাজার টাকা এবং ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা আছে। স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে তিনি ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য

অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর-কাবিখার বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি এই বিপুল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন।

সিংড়া, নাটোর, রাজধানী ঢাকাসহ বিদেশে রয়েছে তাঁর জমি, পুকুর, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে বিপুল এই সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি।

 

আইসিটি প্রকল্পে হরিলুট

ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে ২০১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে ২৫ হাজার কোটি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়।

 


 

এই খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট; বিশেষ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোরজি করার সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন পলক। তাঁর দুর্নীতির অন্যতম উত্স ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাই-কেট পার্ক, আইটি পার্ক ইত্যাদি। আইসিটি খাতে যেকোনো প্রকল্প নিলেই ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো তাঁকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের অনিয়ম পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে এই বড় ধরনের অনিয়মের চিত্র। লুটপাটের অংশ হিসেবে কিছু প্রকল্প সমাপ্ত এবং কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের নামে লুট করা হয়েছে।

 

সিংড়া ও নাটোরে যত সম্পদ

পলকের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সিংড়ায়ই তিনি অঢেল সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে বড় ছেলে অপূর্ব জুনাইদের নামে জামতলী-বামিহাল সড়কসংলগ্ন চওড়া গ্রামে ৪২ বিঘা আমবাগান ও পুকুর, মা জামিলার নামে সুকাশ ইউনিয়নে আগমুরশন গ্রামে পুকুরসহ ৩৬ বিঘা বাগান কিনেছেন। সিংড়া পৌরসভার উপশহর এলাকায় স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা ও শ্যালক লুত্ফুল হাবিবের নামে গড়েছেন দুই কোটি টাকা দামের দুটি বাড়ি।

 


 

শহরের মাদারীপুর ও চাঁদপুর সড়কসংলগ্ন এলাকায় স্ত্রীর নামে পাঁচ কোটি টাকা দামের ১৫ শতক জায়গা কিনেছেন। এ ছাড়া সিংড়া থানা মোড় ও জোড়মল্লিকা এলাকায় শ্যালক রুবেলের নামে গড়েছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। স্ত্রী ও শ্যালকের নামে গড়ে তুলেছেন ইটভাটা ও গরুর খামার। নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দামের জায়গাসহ মা জামিলা বেগম, স্ত্রী কনিকা ও স্বজনদের নামে চলনবিলে ৫০০ থেকে ৭০০ বিঘা সম্পদ গড়েছেন।

দেশে-বিদেশে যত সম্পদ

রাজধানীতে ফ্ল্যাট-বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে পলক দম্পতির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-গাড়ি রয়েছে বলে তাঁর নিকটাত্মীয়রা জানিয়েছেন।

পলকের ফাইভ স্টার সিন্ডিকেট

নিজ এলাকায় পলক ‘ফাইভ স্টার’ নামে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তাঁরা হলেন পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস, সিংড়া দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইটালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ডালিম আহম্মেদ ডন এবং পলকের শ্যালক লুত্ফুল হাবিব রুবেল। এঁদের মাধ্যমেই পলক গড়ে তোলেন বিপুল অবৈধ সম্পদ।


 

এ বিষয়ে কথা বলতে এলাকায় গিয়ে ফাইভ স্টার সিন্ডিকেটের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁদের ব্যক্তিগত অফিসগুলো তালাবদ্ধ। পরে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।

পলকের স্ত্রী শিক্ষিকা থেকে উদ্যোক্তা

পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও স্বামী প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি উদ্যোক্তা বনে যান। যেকোনো প্রকল্প নেওয়া হলে পলকের হয়ে তিনি ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। ২০০৮ সালে পলক পরিবারের সম্পদ বলতে ছিল সর্বসাকল্যে ১৫ শতক মাঠের জমি, ব্যাংকে ৫০ হাজার ও নগদ ১০ হাজার টাকা। পরে এই দম্পতি বনে যান ভিশন বিল্ডার্স লিমিটেড কম্পানির ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। কনিকার নিজ নামে সিংড়ায় রয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে ১৫টি ফ্ল্যাট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কনিকার নিকটাত্মীয়রা জানান, ছয় মাস আগে কনিকা সিংড়ার চোওড়া গ্রামে জামিলা ফয়েজ ফাউন্ডেশনের নামে ৭০ বিঘা জমি কেনেন। একইভাবে হাটমুরশন এলাকায় পুলিশের আলোচিত কর্মকর্তা সাকলাইনের কাছে থেকে ৪২ বিঘা জমি কিনে নেন। নাটোর ডিসি অফিসের সামনে কনিকা তাঁর বাবার নামে কিনেছেন প্রায় এক বিঘা জমি।

কনিকার আরো বড় বিনিয়োগ রয়েছে চলনবিল হাই-টেক পার্ক সিটি এলাকার চারপাশে। সেখানে তিনিসহ পলক সিন্ডিকেটের সদস্যরা শত বিঘার ওপরে জমি কিনেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের স্ত্রী কনিকা ও শ্যালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁরা বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।


 

সিংড়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘২০০৮ সালে পলক তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫ শতাংশ জায়গার মালিক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা শিক্ষিকা পদে চাকরি করতেন। এখন তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এটি আমাদের কাছেও মনে হয়, দুর্নীতি না করে কোনোভাবেই এত টাকা উপার্জন করা সম্ভব নয়।’

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকে পকেটে রাখতেন পলক

সিংড়ার বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিজের পকেটে রাখতেন পলক। বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতাকে টাকা দিয়ে পুষতেন। ফলে পুরো সিংড়ায় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ছিল তাঁর কবজায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিংড়া বিএনপির সদস্যসচিব দাউদার মাহমুদ পলকের বন্ধু। উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম আনু সম্পর্কে তাঁর আপন চাচাশ্বশুর। এ ছাড়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আলী আজগর খান গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে পলকের বাসায় ভূরিভোজে অংশ নেন।


 

এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব দাউদার মাহমুদ বলেন, ‘ছোট এলাকা। এ কারণে আমরা সবাই একসঙ্গে চলেছি। তবে যাঁর যাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা ছিল। এখানে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।’

ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করেননি পলক

এদিকে সিংড়া আওয়ামী লীগে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দলের ত্যাগী নেতাদের পাত্তা দিতেন না পলক। এলাকার চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। বাতিল হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শ্যালক লুত্ফুল হাবিব রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্যও উঠেপড়ে লাগেন।

সিংড়া যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল হাসান কামরান বলেন, ‘ক্ষমতার দাপটে পলক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বঞ্চিত করেছেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করে রাজনীতি করেছেন। আত্মীয়করণের মাধ্যমে সব সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করেছেন। আমার মতো অনেকেই সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহজাহান আলীর ছেলে সরফরাজ নেওয়াজ বাবু বলেন, ‘আমার বাবার হাত ধরে পলকের রাজনীতি শুরু। তবে এমপি হওয়ার পর থেকে জনপ্রিয় কাউকে কোনো পদে রাখেননি তিনি। তাঁর ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি।’

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর পলকও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিদেশে পালানোর সময় বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন তিনি।

তবে পলক গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই তাঁর স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা, তিন সন্তান অপূর্ব, অর্জন ও অনির্বাণ এবং শ্যালক রুবেল দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন