গেল ঈদুল আজহার আগে-পরে ২৬ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনে দেশে ১৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৯ জন নিহত এবং ৩১৮ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ২৮ জন ও শিশু ২৩ জন। ৮১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯৬ জন, যা মোট নিহতের ৪১.৯২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৩১ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৫৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৩.১৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ২৩ জন, অর্থাৎ ১০.০৪ শতাংশ।
এই সময়ে ২৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৬৬ জন নিহত, ২৪ জন আহত এবং ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছে।
৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সংগঠনটির পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে ৭ জন শিক্ষক, ২৬ জন শিক্ষার্থী, ৩ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন সেনা সদস্য, ১ জন বিমান বাহিনীর কর্মচারী, ১ জন উপজেলা প্রকৌশল অফিসের হিসাব রক্ষক, ১ জন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিলিং সহকারী, ২ জন সাংবাদিক, ৪ জন পোশাক শ্রমিক, ১ জন প্রবাসী শ্রমিক, ৩ জন এনজিও কর্মী, ১১ জন স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ৪ জন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৬.৮৯% জাতীয় মহাসড়কে, ৩৪.২২% আঞ্চলিক সড়কে, ১৭.৬৪% গ্রামীণ সড়কে এবং ১১.২২% শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাসমূহের মধ্যে ২৫.১৩% মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২১.৯২% নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ২৮.৮৭% পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ২০.৩২% যানবাহনের পেছনে আঘাত এবং ৩.৭৪% অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী- ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান, ট্রলি-লরি-ট্রাক্টর ২২.৯৫ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১৮.৩৬ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-জীপ ৭.৫৪ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৬.৫৫ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ১৬.০৬ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার ৮.৫২ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা ৩০৫টি। (ট্রাক ৪৮, বাস ৫৬, কাভার্ডভ্যান ৫, পিকআপ ৮, লরি ৪, ট্রলি ৩, ট্রাক্টর ২, মাইক্রোবাস ৯, প্রাইভেটকার ১৪, মোটরসাইকেল ৮১, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র ২৫, ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান ৪৯, পাওয়ারটিলার ১।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে- ভোরে ৫.৮৮%, সকালে ৩০.৪৮%, দুপুরে ১৭.১১%, বিকালে ২৩.৫২%, সন্ধ্যায় ৯.০৯% এবং রাতে ১৩.৯০%।
দুর্ঘটনায় ঢাকা বিভাগে নিহত ৩৭ জন, অর্থাৎ ১৬.১৫ শতাংশ, যা বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি এবং জেলা হিসেবে ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে-১৬ জন, যা মোট নিহতের ৭ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;
২. বেপরোয়া গতি;
৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;
৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;
৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;
৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;
৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;
৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি;
১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি;
১১. সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের অভাব;
১২. ঈদ সময়কালে যানবাহন চালক ও যাত্রীদের মধ্যে অসচেতনতা এবং বেপরোয়া মানসিকতা অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়া।
সংগঠনটির সুপারিশ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;
২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;
৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;
৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী-পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করতে হবে;
৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;
৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;
৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে;
৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;
১০. ঈদের আগে-পরে ১৫দিন সড়ক-মহাসড়কে কঠোর বিশেষ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে;
১১.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়, গত ঈদুল ফিতরের তুলনায় এবারের ঈদুল আযহায় সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উভয়ই বেড়েছে। ঈদুল ফিতরে ১২৮টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সেই হিসাবে ঈদুল আজহায় দুর্ঘটনা ৪৬.০৯% এবং প্রাণহানি ৫৫.৭৮% বেড়েছে।
করোনাভাইরাস সমস্যায় গণপরিবহন সীমিত চলাচলের কারণে মানুষ ব্যক্তিগত ও স্থানীয় ছোট যানবাহন বেশি ব্যবহার করেছে। ফলে এই দুই ধরনের যানবাহনে দুর্ঘটনার মাত্রাও বেড়েছে। উল্লেখ্য, স্থানীয়ভাবে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ ছোট যানবাহন আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখলেও এগুলো সড়ক নিরাপত্তার প্রতি চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এসব যানবাহনের বিকল্প হিসেবে আধুনিক যানবাহন চালু করে পর্যায়ক্রমে এগুলো বন্ধ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার ক্ষেত্রে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। এজন্য সরকারের দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন