শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত খালেদা জিয়া

দীর্ঘ ১২ বছর পর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে আবেগময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তার ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া আজ এখানে আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। এক যুগ ধরে তিনি এই মহাসম্মিলনীতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি।

আজ সুযোগ পেয়েছেন। আমরা সবাই আনন্দিত ও গর্বিত যে এই সুযোগ দিতে পেরেছি আপনাকে। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এই বিশেষ দিবসে সবার সঙ্গে শরিক হওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই অনুষ্ঠানে আপনাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাচ্ছি।

 

খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন অন্তর্বর্তী সরকারের তরুণ দায়িত্বশীলরা। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াসহ অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চান মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম, আপনার শরীর কেমন?’ এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, ‘বেশি ভালো না।

’ মাহফুজ আলম তখন বলেন, ‘আপনাকে ভালো থাকতে হবে। আপনি সামনে এলে কনফিডেন্স পাওয়া যায়।’

 

খালেদা জিয়া এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট সফর করেন। আর ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ড দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তারপর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলেও জনসমক্ষে কোনো অনুষ্ঠানে যাননি তিনি।

সেই হিসাবে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) ছয় বছর পর কোনো অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিলেন।

 

অনুষ্ঠানে পাশাপাশি সোফায় বসা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও খালেদা জিয়াকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে আলাপরত দেখা যায়। এর আগে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে রওনা দিয়ে পৌনে ৪টার দিকে সেনাকুঞ্জে পৌঁছেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন তাকে অভ্যর্থনা জানান। অনুষ্ঠানে আগেই পৌঁছেছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অন্য অনেককেই একই অবস্থায় দেখা যায়।

এর আগে ফিরোজা থেকে সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনাকুঞ্জে যান খালেদা জিয়া। তার গাড়ির সামনে মিলিটারি পুলিশের (এমপি) পাইলট কার এবং পেছনে সেনাবাহিনীর একটি অ্যাম্বুল্যান্সও ছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেনও ছিলেন গাড়িবহরে। সেনাকুঞ্জে পৌঁছে হুইলচেয়ারে করে অনুষ্ঠানে যোগ দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সেনাকুঞ্জ থেকে বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে ফিরোজায় ফিরেও আসেন সেনা স্কট নিয়ে।

বুধবার রাতে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লে. জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল এ এস এম কামরুল আহসান গুলশানের বাসায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন।

এবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়াও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির ২৬ নেতাকে সেনাকুঞ্জে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরো যোগ দিয়েছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আব্দুল মঈন খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ফজলে এলাহী আকবর, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এ কে এম শাসমুল ইসলাম প্রমুখ। এ ছাড়া জেএসডির আ স ম আবদুর রব, জামায়াতে ইসলামীর শফিকুর রহমানসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এর এক যুগ আগে ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তার আগে ২০০৬, ২০০৮, ২০০৯ সালে সশস্ত্র বাহিনীর এই অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই দিবসে তিনি কারাগারে ছিলেন। ২০১০ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এক সপ্তাহ আগে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ইচ্ছার ফল হিসেবে খালেদা জিয়াকে তার পরিবারের দীর্ঘ ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা সেনানিবাসের মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেই বিপর্যস্ত অবস্থায় সে বছর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া যোগ দেননি। এমনকি চারদলীয় জোটের কোনো নেতাকেও সেখানে দেখা যায়নি। সাবেক সেনাপ্রধানসহ অন্যান্য সাবেক সেনা কর্মকর্তার মধ্যে যারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তারাও অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। সেনাকুঞ্জে শামিয়ানার নিচে খালেদা জিয়ার জন্য যে আসনটি রাখা হয়েছিল, তা অনুষ্ঠানের সময় শূন্যই পড়ে ছিল।

সেনাকুঞ্জে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়া তার জীবনের বড় সময়টা দিয়েছেন দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। তাকে (খালেদা জিয়া) পরিকল্পিতভাবে ১২ বছর ধরে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এবার আমন্ত্রণ জানিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আজ গোটা জাতি আনন্দ উপভোগ করছে।’

সেনাকুঞ্জ থেকে ফিরে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকের দিনটিতে খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জে যাওয়ার ঘটনা গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী, এ দেশের গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী দীর্ঘ ১২ বছর পরে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যে আন্দোলন, গণতন্ত্র রক্ষা এবং গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার যে আন্দোলন সেই আন্দোলনে অনেক বড় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ জন্য যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই ঘোষণাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে আপসহীন সংগ্রাম—এই দীর্ঘ বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম সেই সংগ্রামকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এ দেশের মানুষ যে সংগ্রাম করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, প্রাণ দিয়েছে তাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রাণগুলো চলে গেল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা নিঃসন্দেহে এই কথাই স্মরণ করতে চাই যে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আছেন, আজ তিনিও সবচেয়ে বেশি আনন্দিত।’

ঢাকা সেনানিবাসে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ড. ইউনূস। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন উপস্থিত ছিলেন। 

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন