বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, সীমাহীন দুর্নীতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিপুর, অধরা অভিযুক্তরা

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ ১১ বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নসরুল হামিদ বিপু। তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ থাকলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার ভয়াবহ দুর্নীতির নানা তথ্য ফাঁস হচ্ছে। তার ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, মামা কামরুজ্জামান চৌধুরী, শ্যালকসহ অন্য আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী লোকজনের দুর্নীতির নানা চিত্রও প্রকাশ পাচ্ছে।

 


 

দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদকের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, নসরুল হামিদ বিপুর এসব অপকর্মে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল), ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ আলী, বিভিন্ন বিদেশি কম্পানির লোকাল এজেন্ট ফয়সাল এবং ওয়াহিদ সালাম। কিন্তু তারা সবাই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে চালু করা হয়েছিল রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

 


 

২০১০ সালে বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় ব্যাপক হারে শুরু হয় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন। শুরুতে তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। কোনোটি চলছে ১০ বছর, আবার কোনোটি এখন পর্যন্ত চলছে। এসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি।

 

এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় অতি উচ্চ হারে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাত থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।


 

এসব রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও এসব কেন্দ্র গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে।

 

এর মধ্যে ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে সরকারকে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় কেন্দ্র মালিকদের, এটি ক্যাপাসিটি চার্জ।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে। এসব কাজে নসরুল হামিদ বিপু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা যুক্ত ছিলেন।

জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে ৩০ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা দিতে হয়, যার মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ ক্রয় না করে দিতে হয়েছে। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবিকে ৩৭ হাজার ২০৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ক্রয় না করে দিতে হয়। এভাবেই লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হয়।

পিডিবির নিজস্ব প্রকল্পেও দুর্নীতি রয়েছে। গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না জেনেও দুর্নীতির উদ্দেশ্যেই পিডিবি খুলনায় ডুয়েল ফুয়েল ৩৩০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। এই প্রকল্পের নির্মাণ (ইপিসি) ব্যয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার (চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা)। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস না থাকায় ডিজেল দিয়ে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানো হয়। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গ্যাসের থেকে কয়েক গুণ বেশি।

অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এই প্রকল্পে নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠজন ফয়সাল ইপিসি কন্ট্রাক্টরের লোকাল এজেন্ট ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে বিপু চীনের কম্পানি হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনালের (এইচইআই) লোকজনকে বাসায় ডেকে নিয়ে ফয়সালকে লোকাল এজেন্ট করার চাপ প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে কম্পানিটির সব প্রকল্পের লোকাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফয়সাল। বিপিডিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।


 

দুর্নীতি করতে মেগাপ্রকল্পের নামে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পগুলো ব্যয় পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রকল্পগুলোর চেয়েও কয়েক হাজার কোটি টাকা বেশি। পিডিবি ও অন্যান্য সরকারি জেনারেশন কম্পানির মাধ্যমে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেন বিপু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানিতে (ডিপিডিসি) পাওয়ার স্ট্রেন্থেনিং প্রকল্পের নামে চায়না-বাংলাদেশ জিটুজির মাধ্যমে দরপত্র ছাড়াই ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাজ দেওয়া হয় চায়নার টিবিইএ কম্পানিকে। বুয়েটের ব্যুরো রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন (বিটিআরসি) জানিয়েছিল, এই প্রকল্প ব্যয় সর্বোচ্চ ৮৭০ মিলিয়ন, অথচ নসরুল হামিদ বিপুর চাপে বিটিআরসির মতামত উপেক্ষা করে ডিপিডিসি ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে টিবিইএর সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করার মাধ্যমে প্রায় ৮৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোপাট করা হয়। এই প্রকল্পটি ডিপিডিসির প্রয়োজনই ছিল না।

বিপু নিজে সুপারিশ করে তার আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ওয়াহিদ সালামকে টিবিইএর লোকাল এজেন্ট নিযুক্ত করে, যার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়। এ ছাড়া পিজিসিবির একটি প্রকল্পেও বিপুর সুপারিশ করা ব্যক্তি ফয়সালকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করার অভিযোগ রয়েছে। 

বিদ্যুৎ খাতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহকারী চীনা কম্পানি হেগাজিন, শেনজেন স্টার ও কাইফাকে নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বিপু। প্রতিটি মিটারের যন্ত্রাংশ চার থেকে ছয় ডলারের অধিক মূল্যে সরবরাহ করা হয়। চীনের কম্পানিগুলো এই অতিরিক্ত চার থেকে ছয় ডলার বিপুকে প্রদান করে।

বিপুর নির্দেশে বিআরইবি, বিপিডিবি, ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাটিকো এবং নেসকো এই বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো টেন্ডার ছাড়া ডিপিএম-এর মাধ্যমে জয়েন্ট ভেঞ্চার কম্পানিগুলো থেকে অধিক মূল্যে লাখ লাখ মিটার ক্রয় করে। হেগাজিনের লোকাল এজেন্ট বিপুর ঘনিষ্ঠজন শামসুল আলামিন কাজল এবং শেনজেন স্টারের লোকাল এজেন্ট বিপুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মাহবুব। এসব দুর্নীতিতে বিপিএমইসির সিইও সেলিম ভূঁইয়াও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে ভোলার গ্যাস সিএনজি (কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) করতে অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করে সাড়ে চার শ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি। আর এই উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন নসরুল হামিদ বিপু। নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইন্ট্রাকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ আলীর কম্পানিকে কাজ দিতে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনে ভোলার গ্যাস সিএনজি করার চুক্তি করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরই ভোলার গ্যাস সিএনজি আকারে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশে অর্থপাচারকারীদের স্থানীয় সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজেয়াপ্তের চেষ্টা করা উচিত। প্রমাণ সাপেক্ষে অর্থপাচারকারীদের স্থানীয় সম্পদ জব্দ করে নিলাম করা হলেও একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে।’

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন