নিজেকে সৎ রেখে অসততার সাথে গলাগলি করা মানে নিজের সততাকে অর্থহীন করা
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক। |
একজন মানুষ ব্যক্তিজীবনে প্রচন্ড সৎ কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অসততার সমর্থক হলে কৈফিয়তের শৃঙ্খল হতে সে মুক্ত নয়। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। অন্যায় না করেও অন্যায়কে স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া, অন্যায়কারীর পক্ষে কথা বলা আরও বড় অন্যায়। আত্মার ওপর জুলুম। ঘুষ গ্রহীতার সাথে ঘুষ দাতাও জাহান্নামী হবে। সুুতরাং প্রমাণ হয়, অন্যায় থেকে শুধু নিজেকে বিরত রাখলেই হবে না বরং যারা অন্যায়কারী তাদের ছায়ায় থাকা যাবে না, তাদের পক্ষে কথা বলা যাবে না এবং তাদেরকে রক্ষায় কাজ করা যাবে না। প্রত্যেকটি অন্যায় কারো না কারো অধিকার হরণ করে। কেউ না না কেউ কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই ন্যায়ের প্রতি অবিচার করা! কাজেই অন্যায়কে আবৃত রাখা মানে মানুষের অধিকার বিঘ্নিত করা, রাষ্ট্রের কল্যাণ বলি দেওয়া কিংবা কারো দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ানো।
ন্যায় সর্বদা স্থির। আমার জন্য যেটা ন্যায়, তাবৎ দুনিয়ার সবার জন্য সেটাই ন্যায়। ধর্ম-কর্ম মেনে চলি অথচ একজন সুদখোরের সাথে দোস্তি, একজন ঘুষখোরের সাথে আত্মীয়তা, খুনীর জন্য উথলে ওঠা দরদ এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক!- এমন সাধুত্বের মূল্য নাই। অন্যায়কারীর সাথে শক্তি-সামর্থ্যে কুলিয়ে উঠি না, তাই বলে তাকে ঘৃণাও করছি না- তবে ঈমান কোথায়? যদি ঈমান না থাকে তবে অনুশোচিত হয়ে ঈমান নবায়ন না করা পর্যন্ত কারো সিজদাহ, দান-খয়রাত আমলায় নামায় যোগ হওয়ার কোন সম্ভবনা নাই। পোক্ত ঈমান মুক্তির ভিত্তি। যাদের মধ্যে ধর্মের এই বেসিক বিদ্যমান তারা আমল দিয়ে ইমারত গড়লে সেটা টেকসই হয়।
নিজেকে সৎ রেখে অসততার সাথে গলাগলি করা মানে নিজের সততাকে অর্থহীন করা। পারিবারিক সম্পর্কে জড়িতদের যারা অসৎপথে অর্থ আয় করে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় তাদের সাথে আপনার মিল মহব্বত মানে আপনার সততার সংজ্ঞায় ভ্রান্তি আছে। যে দুর্নীতিবাজ কিংবা অন্যায় সংগঠনকারী তাকে যদি সাবধান না করেন, হুঁশিয়ারি বিরত রাখার চেষ্টা না থাকে কিংবা সম্পর্কে দূরত্ব না টানেন তবে সে পাপের ভাগ আপনার দিকেও প্রত্যাবর্তন করবে। সামাজিক কু-রীতি, রাষ্ট্রীয় ভ্রষ্টাচার এবং রাজনৈতিক খুন-খারাবিতে আপনার মৌন সমর্থন থাকলে- এসবের দায় এড়াবেন কী করে? দুনিয়াই তো বিচারের শেষ ক্ষেত্র নয়। ধর্মের অন্যায়কারী এবং অন্যায় পৃষ্ঠপোষকতাকারীর জন্য যে ভয়াবহ পরিণতির স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে- সেখানে সবার জন্য শিক্ষা আছে। স্বার্থের জন্য আমরা কোন অন্যায়ের পক্ষ নিতে পারি না।
প্রকাশ্যে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ালে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে অনন্ত চুপ থাকতে হবে। তবে অন্তর থেকে ঘৃণার প্রবাহ যাতে বন্ধ না হয়। কিন্তু যারা অন্যায়কে কলম দিয়ে লিখে সমর্থন করে, মুখ দিয়ে বলে বৈধতা দিতে চায় কিংবা চিন্তা দিয়ে সমাজে ব্যাপৃত রাখে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। অপরাধীরা মনে করে সম্পদ তাদেরকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে। সেজন্য তারা ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে উম্মাদের মত সম্পদ জড়ো করে এবং বারবার গণনা করে। এদের জন্য ঐশ্বরিক অভিসম্পাত। দুনিয়াতেই এদের জন্য শাস্তির তীব্রতা দেখি। পরকালীন ন্যায় বিচারে কী ভয়াবহ শাস্তিতে পতিত হতে হবে তা যদি মানুষ আন্দাজ করতে পারতো তবে তওবা করে এখনই মৃত্যু কামনা করতো।
ব্যক্তিজীবনে সৎ থাকা জরুরি তবে অন্যায় সঙ্গ ত্যাগ করা, অন্যায়কে সমর্থন না করা আরও বেশি কল্যাণকর। মানুষ তার প্রত্যেকটি কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তিজীবনে নিজেকে সৎ রাখার মধ্যে ব্যক্তি কল্যাণ নিহিত কিস্তু সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় অসততায় সমর্থন রাখা মানে সামগ্রিক অকল্যাণের একজন অংশীদার হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করা। যেখানে অন্যায়ভাবে মানুষকে মারা হয়েছে, জনগণকে ঠকানো হয়েছে কিংবা রাস্ট্রকে পঙ্গু করার উদ্যোগ ছিল- সেখানে আপনার সমর্থন থাকা মানে সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টিতে আপনিও একজন ভণ্ড কাণ্ডারি। অন্যায়ভাবে যদি কোন মানুষকে হত্যা করা হয় তবে সেটা একটি জাতিকে হত্যা করার সামিল। পক্ষ-বিপক্ষ বিচার করে এমন কোন হত্যায় যদি আপনার মৌণ সম্মতিও থাকে তবে সব আমল, সব পরিশ্রম ব্যর্থ করার বীপ বপিত হয়েছে। নিজেকে অন্যায় থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টার সাথে সাথে অন্যায়কারী সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি করতে হবে। খারাপকে খারাপ বলার প্রকাশ্য সাহস-পরিস্থিতি না থাকলেও অন্তর যাতে অপরাধীকে ঘৃণা করে এবং ভুক্তভোগীর জন্য সহমর্মি হয়- মানুষ হিসেবে সেই বোধ সবার মধ্যে ধারণ করা উচিত।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন