হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী//
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বা‘দ। পবিত্র কুরআন আমাদের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত। এটি মানুষকে পবিত্র করে আর সব কিছুর সমাধানও এর মাঝেই নিহিত। রাসূল (সা.)-এর আগমনের সময় আরবজাতি চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। বাকি বিশ্বও এ অন্ধকার থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। এ চরম বিশৃঙ্খল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আরবের মাটিতে নতুন সূর্যের উদয় হয়। পবিত্র কুরআন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব জাতিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলে এবং তারা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়।
পবিত্র কুরআন স্বল্প সময়ে আরব জাতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করে। এতে তারা এক আল্লাহর ইবাদতকারীতে পরিণত হয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় এ হলো মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। নিশ্চয় তোমার প্রভু-প্রতিপালক নিজ সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নামল : আয়াত ৭৭-৭৮)। পবিত্র কুরআন এমন এক ঐশীগ্রন্থ যার কোনো স্ববিরোধিতা নেই। যেভাবে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা এ কুরআনে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে না? আর এ (কুরআন) যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে এসে থাকত, তাহলে নিশ্চয় তারা এর মাঝে অনেক স্ববিরোধিতা খুঁজে পেত।’ (সূরা আন নেসা : আয়াত ৮২)। এ আয়াতের অর্থ এটাই, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ যদি এ পবিত্র কুরআনের প্রণেতা হতো তাহলে মানুষ এর মাঝে নিশ্চয় অনেক স্ববিরোধী শিক্ষা ও কথা দেখতে পেত কিন্তু পবিত্র কুরআনে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতা নেই। আমরা যেন নিয়মিত পবিত্র কুরআন পাঠ করতে থাকি সে বিষয়েও আল্লাহতায়ালা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহপাক বলেন, ‘তুমি সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে রাতের ঘোর অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম কর এবং প্রভাতে কুরআন পড়াকে গুরুত্ব দাও, নিশ্চয় প্রভাতে কুরআন পাঠ এমন একটি বিষয় যে, এ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া হয়।’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৭৮)। হজরত উমর (রা.) ইসলামের একজন মহান খলিফা হয়েছিলেন এবং তার সময়ের একজন মহান শাসক ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, কীভাবে পবিত্র কুরআনের বাণী শোনার মাধ্যমে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এটি কুরআনের এক বিপ্লব, যে উমর (রা.) আগে ইসলামের চরম শত্রু ছিলেন তাকেও কুরআন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তিনি আনুগত্যে এতটাই অগ্রসর হয়ে যান যে, পরবর্তী সময়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হন।
একইভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) যিনি ইসলামের মহান শাসক ছিলেন এবং যার সময়ে ইসলামিক সাম্রাজ্য মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, তিনিও পবিত্র কুরআনের আয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল (সা.)-এর সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন হজরত জাফর ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসছিলেন তখন তার সঙ্গে কয়েকজন খ্রিষ্টান নাবিক ছিল। রাসূল (সা.)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে এবং তারা সে মুহূর্তেই ইসলাম গ্রহণ করে। রাসূল (সা.) জানতে চান, ইথিওপিয়াতে গিয়ে তারা কি আবার তাদের আগের ধর্মে ফিরে যাবে কিনা। তারা বলে, তারা কখনো ইসলামকে পরিত্যাগ করবে না।
এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে; যেখানে পবিত্র কুরআন সব ধরনের অন্ধকারকে আধ্যাত্মিক আলোতে রূপান্তর করেছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা কুরআন পড়, কারণ, কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য শাফায়াত করবে।’ (মুসলিম)। পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য পথ-প্রদর্শক। এর মধ্যে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধান বিদ্যমান। এমন এক পরিপূর্ণ কিতাব যার মাঝে আধ্যাত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্তিদানকারী ব্যবস্থাপত্র রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা প্রভাতের তেলাওয়াতের মহিমা বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ কী? এর দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথমত তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ আর দ্বিতীয়ত ফজরের নামাজ আদায়ের পর কুরআন পাঠ। এরূপ কাজ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে তার প্রতিদিনের কর্ম সূচনা করে, দিনের বাকি অংশটুকু তার উত্তমভাবে কাটানোটাই স্বাভাবিক। হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, কুরআন পাঠকারীর জন্য কিয়ামতের দিন কুরআন শাফায়াতকারী হবে। এ থেকে বোঝা যায়, কুরআন পাঠের গুরুত্ব কত বড়।
আমাদের সবার উচিত হবে, প্রতিদিন সকালে কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হওয়া। কেননা, এরই মাঝে সব কল্যাণ নিহিত। আমরা যদি পবিত্র কুরআন স্বচ্ছ হৃদয় নিয়ে পাঠ করি আর এর নির্দেশাবলির ওপর আমল করে চলি তাহলে অবশ্যই আমরা সব ধরনের পাপ এবং সমস্যা থেকে দূরে থাকব। শুধু পবিত্র কুরআন পাঠ করলেই হবে না, এর অর্থ বুঝতে হবে এবং এর নির্দেশাবলির ওপর আমল করতে হবে। কেননা, এ কুরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াতের কারণ। যারা সৎ নিয়তে এ কুরআন পাঠ করবে এবং এর ওপর আমল করবে তারা অবশ্যই হেদায়াত লাভ করবে, এটা আল্লাহপাকের ওয়াদা।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করার, এর প্রকৃত অর্থ বোঝার এবং এর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন