কালের পালাক্রমে সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে কখনোই চিড় ধরবে না
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
যে দেশে আযানের সময় পুজার বাদ্যযন্ত্র থেমে যায় আবার পুজার সময় মুয়াজ্জিন আযান পিছিয়ে দেয়- এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি দেশ তুমি কোথায় পাবে? যে দেশে মুসলিমের চাঁদার টাকায় পুজো হয় আবার হিন্দুর দানের টাকায় ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হয় তেমন একটি দেশ বিশ্বমানচিত্রে দ্বিতীয়টি দেখাও। মেসে- যেখানে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে থাকে সেখানে কোনদিন খাদ্যতালিকায় গোরু থাকবে- এটা নিয়ে মারামারি হয়েছে? বরং যে রান্না হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে বসে ভক্ষণ সেখানে গোরু-শুয়োর কোনটিকে বিশেষভাবে রাখতে হবে আর কোনটিকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে- এটা নিয়ে কাইজ্জা হয় নি। যার যা খুশি সে সেটা খাবে, যার অপছন্দ সে দূরে থাকবে। কাউকে চাপিয়ে দেওয়া বা ছিনিয়ে নেওয়ার অসুস্থ সংস্কৃতি এই দেশে নাই।
আমি যে জনপদে বেড়ে ওঠেছি সেখানে হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই হয়ে বাঁচে। মুসলিমদের বিপদ-আপদে হিন্দুরা সবার আগে এগিয়ে আসে আবার হিন্দুদের উৎসবে প্রধান মেহমান মুসলিম নরনারী। আমার গ্রাম তো সমগ্র বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিচিত্র। এদেশে কোনদিন কার ধর্ম বড়, মসজিদ-মন্দিরের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ফ্যাসাদ হয়নি। মাইকে আল্লাহ-ভগবান না ডাকলেও ভগবান-আল্লাহ যে তা শোনেন এই বোধ আছে বলেই আমাদের মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা বোধের পরিচয় কখনোই কলঙ্কিত হয়নি। আলেমের বাড়িতে হিন্দু বারুই থেকে কিনে আনা পান-সুপারিতে হরদম উৎসব চলে আবার হিন্দুর ছেলের পেটে ব্যথায় পানি পড়া গ্রামের মৌলভিই ফুঁ দিয় দেয়। হিন্দু-মুসলিম একই বাজার থেকে কেনাকাটা করে, এক ময়দানে খেলাধুলা করে কিংবা এক নদীতে গোসল-স্নান করে বেড়ে ওঠার এবং মরে যাওয়ার যে গল্প তাতে কোনদিন ফ্যাসাদ লাগেনি। গোরস্থান কিংবা চিতা মারামারিতে মাতেনি। হিন্দুর মরনে মুসলিম সম্পর্ক স্মরণ করে কেঁদেছে, মুসলিমের অসুখে হিন্দু সান্ত্বনা দিয়েছে- কই, কখনো তো লাঠালাঠি হতে দেখেনি।
আমি আমার এলাকার হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের তিরিশ বছরের প্রত্যক্ষ দলিল। আরও ৫০০ বছরের বই-পুস্তকের দালিলিক ইতিহাস জানি। অথচ ধর্ম নিয়ে তারা মারামারি করেছে- এমন বিভেদের কিচ্ছা কোনদিন দেখিনি, কারো কাছে শুনিনি কিংবা কোথাও পড়িনি। বিকালে চায়ের দোকানে মন্দিনের পুরোহিত মসজিদের ইমামের শরীরের খোঁজ নেয় আবার মসজিদের মুসল্লী মন্দিরের পূজারীর সাথে এক বৈঠকে বিচার সালিশ করে। কখনোই লাঠালাঠি না করা সমাজটি নিয়ে কারা ষড়যন্ত্র করছে? কারা বাঁধিয়ে দিতে চাচ্ছে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে দাঙ্গা? উসকানিদাতাদের রুখে দিতে হিন্দু-মুসলিমের একাট্টা হওয়া জরুরি। এই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে প্রশংসিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধারণ করে। কেউ যাতে এখানে কোন দাগ বসাতে না পারে। লেপন করতে না পারে কোন কলঙ্ক- সাবধান, সাবধান। রক্তের দাগ একবার লেগে গেলে তা আর মোছা যায় না। ক্ষত আর সারে না।
কালের পালাক্রমে সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে কখনোই চিড় ধরবে না। যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কায়দা করে ধর্মে ধর্মে সংঘাত সংগঠন করে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন করতে চায়, নিঃসন্দেহে তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। পার্শ্ববর্তী কিংবা প্রতিবেশী যে দেশগুলো আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে দেশকে অশান্ত করতে ইন্ধন দিচ্ছে, যে সকল মিডিয়া উসকানি দিচ্ছে সকাল-বিকাল, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের দু'পক্ষকেই নিরিবিলিতে বিবেক দিয়ে দু'মিনিট ভাবার অনুরোধ করছি। ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে যারা দেশের পরিস্থিতিকে অশান্ত করতে চায় তারা আমাদের বন্ধু নাকি বন্ধুত্বের ছদ্মবরণের শত্রু তা চিহ্নিত করা জরুরি। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হলে মা(দেশ) জেতে না।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঐক্য থাকতে হবে। এই দেশ, দেশের মানচিত্র, জাতীয় সংগীত কিংবা জাতীয় পতাকার ওপর আঘাত আসলে সেটা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অস্তিত্বের ওপর সমভাবে আঘাত। এই দেশের ওপর মুসলমানদের অধিকার যতটুকু হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের হিস্যাও ঠিক ততটুকু। দেশপ্রেমের প্রশ্নে কোন আপোষ থাকা উচিত নয়। দিনশেষে হিন্দুর বাড়িতে মুসলিম আমন্ত্রিত হবে এবং মুসলিমদের বাড়িতে হিন্দু নিমন্ত্রিত হয়ে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করবে। আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে কোন অপশক্তি যাতে আমাদেরকে দ্বিখণ্ডিত করতে না পারে। তারা যত ষড়যন্ত্র করুক না কেন কোন ফাঁদেই যাতে আমাদের পা না পড়ে। ষড়যন্ত্রকারীদেরকে আমাদের সহ্য ও সহনশীলতার পরীক্ষায় পর্যুদস্ত করে বিতাড়িত করতে হবে।
এই দেশের অভ্যন্তরে হিন্দু-মুসলমান তথা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কতিপয় কুলাঙ্গার আছে। যাদের উদ্দেশ্য দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা নস্যাৎ করা। তারা উগ্রতা ছড়াবে, উসকানি দেবে। এদের দ্বারা শিক্ষিত-সভ্যজন যাতে সংক্রমিত না হয় সেজন্য সামাজিক ঐক্য-সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় উম্মাদনা বাড়ে এমন সকল গুজব প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাস্ট্রকে শক্ত হাতে সন্ত্রাসীদেরকে দমন করতে হবে এবং যেসকল রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলা তৈরি করার অপচেষ্টা করছে তাদেরকে কড়া বার্তা দিতে হবে। হিন্দুর মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুসলিমের মসজিদ অক্ষত থাকা অর্থহীন! আবার মুসলিমের স্বাধীনতা বিনষ্ট হলে হিন্দুর মনুষ্যত্ব সুস্থ- সেটা বিবেচ্য হবে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে হিন্দু মুসলিম একে অপরের পরিপূরক হয়ে সবাই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর ধারণা পুঁজিবাদের সৃষ্ট মোড়লিপনা ফলানোর ধারা এবং মানুষকে দাসে পরিণত করার ফাঁদ। এই দেশে সবার অধিকার এবং সুযোগ সমান। বাংলাদেশের এই ধর্মভিত্তিক সম্প্রীতি যাতে পৃথিবীর ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে- সেজন্য ধৈর্যশীল জাতি হিসেবে আমাদেরকে পরিচয় দিতে হবে। কথা বলতে হবে প্রজ্ঞার সাথে এবং কোন সংকট মোকাবিলায় সচেতন ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। হিন্দুর টিকি-পৈতা এবং মুসলমানের দাঁড়ি-টুপির সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোন কাজ আমরা কেউ যাতে ভুলেও না করি কিংবা করার কথা না ভাবি। বাংলাদেশ- আত্মসম্মান নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সভ্যতা-সম্প্রীতিতে উদ্ভাসিত হোক- আমাদের প্রার্থণা
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন